মানসিক রোগগুলোর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হল অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার (Obsessive Compulsive Disorder)। আমাদের দেশে লাখ লাখ মানুষ এরোগে ভুগছেন। এরোগে তাদের ও অন্যদের পারিবারিক, সামাজিক ও পেশাগত জীবন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এই প্রকার রোগকে আমরা বাংলায় “শুচিবাই” বলা হয়ে থাকে। অনেকেই জানেন না যে এটি একটি মানসিক রোগ এবং এর চিকিৎসার দরকার আছে। এজন্য কালের আবহে এরোগ ভয়াবহ রূপ ধারণ করে।
উদাহরণস্বরূপ, কোন কিছু দুইবার চেক করা একটি সাধারণ আচরণ। যেমন ধরুন- গেটের তালা লক করেছে কিনা কিংবা বাইরের রুমের লাইট নিভিয়েছে কিনা সেটা যাচাই করা। কিন্তু আপনি দরজা বন্ধ করেছেন কিনা বা লাইট নিভিয়েছেন কিনা এমন ঘটনা যদি ২০ বার বা ৩০ বারের মত মনে সন্দেহ জাগায়, তখন এটাকে আর সাধারণ বলা যায় না।
OCD হল একটি চিন্তাবাতিকগ্রস্থ ও বাধ্যতাধর্মী আচরণের (শুচিবাই) একটি উদ্বেগজনিত রোগ। ধরা যাক, কারো মনে হল, তার হাতে বা গায়ে ময়লা লেগে আছে, যদিও তিনি ভালো করেই জানেন কোথাও ময়লা নেই, তারপরও চিন্তাটি বার বার আসতে থাকে এবং তিনি বার বার হাথ ধুতে যান, এমনকি বার বার সাবান ব্যবহার করতে থাকেন। এখানে ময়লার চিন্তাটি হল অবসেশন (Obsession), আর হাত ধোয়া হল কম্পালশন (Compulsion)। এ দুটি মিলিয়ে রোগটির নাম দেওয়া হয়েছে অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার (Obsessive Compulsive Disorder, OCD)। সারাবিশ্বে প্রতি ৫০ জনের ১ জন জীবনে কোন না কোন সময়ে এরোগে ভোগে তবে সাধারণত তরুন তরুণীদের মধ্যেই এরোগের প্রকোপ বেশি দেখা যায়।
OCD-রোগের লক্ষণ কী কী ?
১। অত্যাধিক চিন্তা : এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা সর্বদা আবেশিক (Obsessive) চিন্তা ভাবনায় মথিত হয়। রোগীর মনের ভিতর একই বাক্য ও গানের সুর বার বার তার অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভেসে আসে, কোনোভাবেই তিনি তার থেকে বের হতে পারে না।
২। অমূলক ভয় : রোগীর মধ্যে জটিল কিছু ভয় মিশ্রিত চিন্তা বার বার দেখা দেয়। তিনি ভয় পেতে থাকেন যে তার হয়তো ক্যান্সার, এইডস বা সিফিলিস হবে। যদিও এসব তার অমূলক ভয়।
৩। অশ্লীল চিন্তা : অশ্লীল চিন্তা অনিচ্ছা সত্ত্বেও এদের মনে বাসা বাঁধে।
৪। কাজ করেও না করা ভাবা : চিঠি ডাকবাক্সে ফেলেও কিছুক্ষণ পরে মনে হয়, চিঠি বোধ হয় ফেলা হয়নি। একই কাজ বারবার করেও ভাবে যে, সে তা করেনি।
৫। একই কাজ বারবার করা : এই রোগী সংশয় ও সন্দেহের বশে বাধ্য হয়ে একই কাজ বারংবার করে। বাড়ির বাইরে বেরনোর সময় হয়তো আলো ও পাখা বন্ধ করেছে। কিন্তু কিছু দূর গিয়ে তাদের মনে হয় আলো ও পাখা বন্ধ করা হয়নি, এবং আবার বাড়িতে ফিরে এসে পরীক্ষা করে দেখে।
কোন ব্যক্তির Obsessive thought বার বার তার মনে ঘুরে ফিরে আসতে। এক্ষেত্রে যে প্রধান উপাদানগুলি এই Obsessive thought-কে বার বার ফিরে আসতে সহায়তা করে সেগুলি হল-
1. Dirt & Contamination
2. Aggression
3. Sex
4. Religion
5. Orderliness
6. Illness
OCD-র কারণ
অন্য অনেক রোগের মতো OCD-এর সঠিক কোন কারণ এখনও আবিষ্কার হয়নি। কেই বলেন, মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় সমস্যা কিংবা ঠিক মতো কাজ না হওয়ার কারণে, কেউ বলেন কিছু কিছু নিউরোকেমিক্যাল-এর তারতম্যের কারণে, কেউ আবার জেনেটিক বিষয়গুলোকে কারণ হিসেবে দাড় করাতে চেয়েছেন। এসবের মধ্যে মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট কিছু স্থানে সামান্য তারতম্যের বিষয়টিকেই সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। OCD-এর কিছু কারণ নিম্নে উল্লেখ করা হল-
১) Genetic : বংশগত কারণে এই রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটতে পারে, পরিবারের কারোর এই রোগ থাকলে পরবর্তী প্রজন্মে কিংবা তার পরবর্তী প্রজন্মে দেখা দিতে পারে।
২) Environmental : সাধারণত অতিরিক্ত মাত্রায় সাংসারিক কিংবা কর্মক্ষেত্রে কিংবা অন্যান্য ক্ষেত্রে মানসিক চাপের পরবর্তী সময়ে এরোগের প্রাদুর্ভাব ঘটতে পারে।
৩) Neurostructural : মস্তিষ্কের গঠনগত কারণ। Basal ganglia বড় হয়ে যায়, Cortical atrophy বা মস্তিষ্কের Gray matter কমে যায়।
৪) Neuro-chemical : সেরোটনিন নামক Neurotransmitter-এর সমস্যা হয়।
৫) Medical Cause : Basal ganglia lesion বাচ্ছাদের গলায় Streptococcal গলায় সংক্রমণ হয়। আমরা জানি, আমাদের মস্তিস্কে প্রতি মুহূর্তে অনেক চিন্তা-ভাবনা আসে। আমাদের মস্তিষ্ক প্রয়োজন অনুসারে এগুলোকে ফিল্টার করতে থাকে। যখন চিন্তাগুলো সঠিক মতো ফিল্টারিং হয় না, তখন মস্তিষ্কে যত চিন্তা আসে তাকে সরানো যায় না, তারফলে OCD বা শুচিবাই দেখা দেয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানে কিছুদিন পূর্বেও OCD-কে Anxiety Disorder-এর মধ্যে ধরা হতো। সাম্প্রতিককালে এটিকে Anxiety Disorder থেকে আলাদা করা হয়েছে।
৬) Abnormal Personality : দেখা যায় যাদের OCPD (Obsessive Compulsive Personality Disorder) নামক অস্বাভাবিক ব্যক্তিত্ব থাকে তাদের ২০-৩৫% পরবর্তী সময়ে Obsession হয়।
উপরোক্ত নানা কারণ আলোচনা করা হলেও, প্রকৃত কারণ চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় আজও অজানা।
OCD-র চিকিৎসা
OCD-তে ব্যবহৃত বেশকিছু চিকিৎসা নিম্নে উল্লেখ করা হল-
১) Psychological : Exposure and response prevention মানে রোগী ময়লায় হাত দেবে কিন্তু হাত ধুতে পারবে না। Thought stopping চিন্তাকে আটকানোর চেষ্টা, যখন চিন্তা আসবে তখন হাতে লাগানো রাবার ব্যান্ডে টান দেবে। Thought sanitation অস্বাভাবিক চিন্তাকে খাতায় বার বার লেখা, চিন্তার কথাগুলো রেকর্ড করে শোনা যাতে সংবেদনশীলতা কমে যায়।
২) CBT : Cognitive Behavioral Therapy রোগীর চিন্তার ত্রুটি-কে সনাক্ত করে দূর করার চেষ্টা করে Psychotherapy, Relaxation training ও Meditation-এর মাধ্যমে।
৩) Medicine : এক্ষেত্রে বিভিন্ন ঔষধ উচ্চ মাত্রায় দিলে এবং TCA, SSRI বা বিষন্নতা নাশক আস্তে আস্তে দিলে অবসেশন ধীরে ধীরে কমতে থাকে। Benzodiazepine স্বল্পকালীন সময়ে দেওয়া যেতে পারে যা ৩ সপ্তাহের বেশি নয়, এটা মনের অস্থিরতা কমাবে।
৪) Social : রোগীকে তার বয়স, যোগ্যতা, আগ্রহ অনুসারে একটু কম চাপের কোন পেশায় আত্মনিয়োগ করা যায়। অন্যান্য চিকিৎসা DBS (Deep Brain Stimulation) কিংবা Psychosurgery- caudate nucleus কেটে ফেলা ইত্যাদি।
৫) ECT : Electroconvulsive Therapy বা বৈদ্যুতিক চিকিৎসা, এটি সাধারণত resistance OCD তে দেওয়া যায়। তবে নিজে নিজে এই চিকিৎসার ব্যবস্থা করা খুবই বিপদজনক। অবশ্যই একজন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ বা চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে কাজটা করাই ভালো।
_____________________________