- সুস্বাস্থ্য- শিক্ষকতার পেশায় একজন শিক্ষকে খুবই পরিশ্রম করতে হয়, সেক্ষেত্রে একজন সুশিক্ষকের প্রধানতম গুণ হবে তার সুস্বাস্থ্য। তিনি যে দেখতে সুন্দর, অপরুপ হবেন সেকথা বলা হচ্ছে না, তার ব্যক্তিত্ব যেন শিক্ষার্থীদের আকর্ষণ করতে পারে। তবেই তিনি শিক্ষার্থীদের মনে প্রভাব বিস্তার করতে পারবেন। তাঁর চেহারায় ব্যক্তিত্বের ছাপ থাকলে তবেই তিনি তাঁর পেশায় সফলতা আনতে সক্ষম হবেন।
- কণ্ঠস্বর- শিক্ষকতার পেশায় শিক্ষকের কণ্ঠস্বর অন্যতম উপাদান হিসাবে বিবেচিত হয়। কারণ, একজন শিক্ষকের কণ্ঠস্বরই শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে সম্পর্কের সেতু বন্ধন করে। একজন শিক্ষকের কণ্ঠস্বর উচ্চ ও সুমিষ্ট হওয়া বাঞ্ছনীয়।
- স্পষ্ট উচ্চারণ- একজন শিক্ষকের উচ্চারণে কোন প্রকার জড়তা থাকবে না। উচ্চারণ স্পষ্ট হবে, তোতলামি এবং আঞ্চলিক প্রভাব থেকে মুক্ত হবে।
- তীক্ষ্ণ বুদ্ধি- একজন শিক্ষককে অবশ্যই তীক্ষ্ণ বুদ্ধি সম্পন্ন হতে হবে। শিক্ষাকার্য পরিচালনা করা একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। শিক্ষার্থীকে সুসংহত এবং সুশৃঙ্খলভাবে বিদ্যালয় পরিবেশ পরিচালনা করতে প্রচুর বুদ্ধি, বিচারবোধ, বিচক্ষণতা এবং দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন।
- রসজ্ঞান- শিক্ষকতার পেশায় যেটি ভীষণভাবে প্রয়োজনীয় সেটি হল শিক্ষকের রসবোধ। শিক্ষকের যদি রসবোধ না থাকে তবে তিনি শিক্ষার্থীদের মনকে স্পর্শ করতে পারবে না। একজন শিক্ষক যখন শ্রেণীকক্ষে শিক্ষাদান করবেন তখন যদি তিনি কোন মজার উদাহরণ ব্যবহার করেন তবে তা দ্রুত শিক্ষার্থীদের মনে প্রবেশ করে, এছাড়াও শ্রেণীকক্ষের একঘেয়েমিতা অনেকাংশে দূর করা সম্ভব হয়।
- ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা- একজন ব্যক্তির মধ্যে যদি ধৈর্য না থাকে, তবে আমার মনে হয় তার এই পেশায় আসার দরকার নেই। কেননা শিক্ষকতার পেশার প্রধানতম গুণ হল অসীম ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা। একজন শিক্ষকের শিক্ষার্থীদের সমস্যা ধৈর্য সহকারে শুনতে হবে এবং সেই সমস্যা সম্যকভাবে উপলব্ধি করতে হলে অসীম সহিষ্ণু হতে হবে।
- সামাজিক- প্রকৃত মানুষ গড়ে ওঠে সমাজের মধ্যে। সেহেতু একজন শিক্ষকের সামাজিক-সংস্কৃতি, ঐতিয্য, ভাষা, ইতিহাস, রীতিনীতি ইত্যাদি নখদর্পণে থাকা উচিত। আমাদের এটা মাথায় রাখা উচিত, একজন সামাজিক ব্যক্তি পারে শিক্ষার্থীদের সামাজিকীকরণের শিক্ষা প্রদান করতে।
অর্জিত গুণাবলী : একজন শিক্ষক শিক্ষকতার পেশায় আসার পর যে সকল গুণাবলী অয়ত্ত করে থাকে, তা অর্জিত গুণাবলীর অন্তর্গত। শিক্ষণ একটি শিল্পকর্ম, সেহেতু এই ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করতে গেলে বেশ কিছু কৌশল বা দক্ষতা অর্জন করতে হয়। শুধুমাত্র জন্মগত দক্ষতার উপর ভিত্তি করে শিক্ষণকার্য পরিচালনা করা সম্ভব নয়। একজন শিক্ষকের বিভিন্ন প্রকার অর্জিত গুণাবলী সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হল-
- বিষয় সম্পর্কে গভীর জ্ঞান- একজন শিক্ষকের শিক্ষণীয় বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকবে। একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীদের যে বিষয়ে শিক্ষা দেবেন সেই বিষয়ে তাঁর গভীর জ্ঞান থাকা বাঞ্ছনীয়। এছাড়া শুধুমাত্র পাঠ্যবিষয়ে নয় অন্যান্য ক্ষেত্রেও তাঁর অল্পবিস্তর জ্ঞান থাকা দরকার। বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান থাকলেই তবে তিনি যথার্থ জ্ঞানদান করতে সক্ষম হবেন।
- শিক্ষামূলক প্রদীপনের ব্যবহার- শিখন-শিক্ষণকে কার্যকরী করে তুলতে হলে একজন শিক্ষকের অবশ্যই শ্রেণীকক্ষে শিক্ষামূলক প্রদীপনের ব্যবহার করা উচিত। এই শিক্ষামূলক প্রদীপনের মাধ্যমে যেকোনো বিষয়বস্তুকে শিক্ষার্থীদের সামনে মূর্ত করে তোলা সম্ভব। এর ফলে একজন শিক্ষার্থী খুব সহজেই কোন কঠিন বিষয়বস্তুকে অয়ত্ত করতে পারে।
- মনোবিদ্যার জ্ঞান- বর্তমান শিক্ষা শিশুকেন্দ্রিক; যেখানে শিশুর অগ্রহ, চাহিদা, সামর্থ্য-কে প্রাধান্য দেওয়া হয়ে থাকে। সেহেতু একজন শিক্ষকের যদি মনস্তত্ত্বের জ্ঞান না থাকে তাহলে কোন অবস্থাতেই ভালো শিক্ষক হওয়া যায় না। একজন শিক্ষকের কাজ শুধুমাত্র শুষ্ক বৌদ্ধিক জ্ঞানদান করা নয়, পরিস্থিতি বুঝে শিক্ষার্থীকে যথা সম্ভব তার আগ্রহ ও চাহিদাকে প্রাধান্য দিয়ে শিক্ষাদান করা।
- শিক্ষাপদ্ধতির ধারণা- একজন শিক্ষককে শিক্ষকতার পেশায় আসার পর তাকে বিভিন্ন শিক্ষাপদ্ধতি সম্পর্কে ধারণা আয়ত্ত করা খুবই জরুরি। শিক্ষাপদ্ধতি হল এমন একটি প্রক্রিয়া যা শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে জ্ঞানের যোগসূত্র স্থাপন করে। সেহেতু একজন শিক্ষক যদি যথাযথ ও সুসংহতভাবে শিক্ষদান করতে পারে তবেই তার পেশায় সাফল্য আসবে, তবে সেক্ষেত্রে তাকে বিভিন্ন পদ্ধতি প্রয়োগ করে শিক্ষাদান করতে হবে।
- বিদ্যালয় পরিচালনা- শিখন ও শিক্ষণ সম্পর্কে ধারণা আয়ত্ত করা ছাড়াও একজন শিক্ষককে বিদ্যালয় পরিচালনার বিভিন্ন দিক সম্পর্কে ধারণা আয়ত্ত করাও ভীষণ জরুরি। বিদ্যালয় সংগঠন, স্বাস্থ্যনীতি, কর্মকেন্দ্রিক শিক্ষার নীতি ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকলে তবেই তিনি তাঁর পেশায় সফল হতে পারবেন।
- জীবনাদর্শ গঠনে- একজন শিক্ষকের প্রধান দায়িত্ব বা কাজ হল একজন শিক্ষার্থীর জীবনাদর্শ গঠনে তাকে সহায়তা করা। তবে এক্ষেত্রে একজন শিক্ষককে উন্নত চরিত্রের অধিকারী হতে হবে, কারণ একজন শিক্ষার্থী সর্বদাই তার শিক্ষককে অনুকরণ করে থাকে। একজন শিক্ষক সর্বদাই তার শিক্ষার্থীদের নৈতিক আদর্শে উদ্বুদ্ধ হতে সহায়তা করবে, যার ভিত্তিতে একজন শিক্ষার্থীর জীবনাদর্শ গড়ে উঠবে।
- নৈতিক মূল্যবোধের বিকাশ- একজন শিক্ষক সর্বদাই তার শিক্ষার্থীদের নৈতিক মূল্যবোধের শিক্ষাদান করবেন। শিক্ষক তার শিক্ষার্থীদের সমাজে ভাল-মন্দ, উচিত-অনুচিতের মধ্যে পার্থক্য করতে শেখানোর শিক্ষা প্রদান করেন, এবং সেই মত আচরণ সম্পাদনে একজন শিক্ষার্থী সমাজের যোগ্য নাগরিক হিসাবে নিজেকে তুলে ধরতে সক্ষম হয়।
- সর্বাঙ্গীণ বিকাশ সাধন- একজন শিক্ষার্থীর সর্বাঙ্গীণ বিকাশ সাধন করাও একজন শিক্ষকের দায়িত্বের অন্তর্গত। একজন শিক্ষার্থীর দৈহিক, বৌদ্ধিক, সামাজিক, নান্দনিক, আধ্যাত্মিক, প্রাক্ষোভিক ইত্যাদি সকল দিকের বিকাশ সাধন করা একজন শিক্ষকের প্রধানতম দায়িত্ব।
- বিষয়বস্তু নির্বাচনে– একজন শিক্ষার্থী তার বাঞ্ছিত লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য কী কী বিষয় নির্বাচন করবে, সেক্ষেত্রেও একজন শিক্ষক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। কেননা সঠিক বিষয়বস্তু নির্বাচন শিক্ষার সঠিক রুপদানে সহায়ক, এক্ষেত্রে একজন শিক্ষক নিজ অভিজ্ঞতা প্রয়োগ করে শিক্ষার্থীকে সঠিক বিষয়বস্তু নির্বাচনে সহায়তা করবেন।
- বৃত্তি নির্বাচনে সহায়তা– একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীর বৃত্তি নির্বাচনের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবেন। তিনি সমাজের একজন প্রতিনিধি হিসাবে শিক্ষার্থীকে যোগ্য করে তুলতে সাহায্য করবেন। তবে এক্ষেত্রে একজন শিক্ষক বিভিন্ন ধরণের বৃত্তিগত ক্ষেত্র সম্পর্কে পরিচিত হবেন এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে যোগদান করার জন্য শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করবেন।
- জাতীয় সংহতি স্থাপনে– একজন শিক্ষক সর্বদাই শিক্ষার্থীদের মধ্যে জাতীয় সংহতি স্থাপনে সচেষ্ট হবেন। তিনি বিভিন্ন শ্রেণীকর্মসূচি, শ্রেণীবহির্ভূতকর্মসূচি ও বিভিন্ন সামাজিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণে সুযোগদানের মধ্যেদিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে জাতীয় সংহতি স্থাপনের চেষ্টা করবেন।
- কুসংস্কার দূর করতে– একজন শিক্ষকের কাজ যেমন শিক্ষার্থীদের মধ্যে জাতীয় সংহতি স্থাপন করা, তার সাথে একজন শিক্ষার্থীকে সমাজের বিভিন্ন কুসংস্কার থেকে মুক্ত করাও একজন শিক্ষকের কাজের অন্যতম দিক। তবে এক্ষেত্রে যথাযথ বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাদানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীকে কুসংস্কার মুক্ত করতে হবে।
- সমাজ নেতা- শিক্ষক সমাজ সেবার আদর্শে নিজে যেমন উদ্বুদ্ধ হবেন তেমনি তারা শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করবেন। সমাজকে গড়ে তোলার লক্ষ্যে তিনি একজন উপযুক্ত ও যথার্থ সমাজ নেতার ভূমিকা পালন করবেন।
- বন্দ্যোপাধ্যায়, অর্চনা। শিক্ষাদর্শন ও শিক্ষানীতি। বি. বি. কুন্ডু গ্র্যান্ড সন্স, পৃষ্ঠা : ২৩৯-২৫১
- পাল, ড. অভিজিৎ কুমার। শিক্ষাদর্শনের রূপরেখা। ক্লাসিক বুকস, পৃষ্ঠা : ৩১-৩৭
- ইসলাম, ড. নূরুল। শিক্ষাতত্ত্বের রূপরেখা। শ্রীধর প্রকাশনী, পৃষ্ঠা : ১৯০-২০১
- হালদার, অধ্যাপক গৌরদাস ও শর্মা, আধ্যাপক (ড.) প্রশান্তকুমার। শিক্ষাতত্ত্ব ও শিক্ষানীতি। ব্যানার্জী পাবলিশার্স, পৃষ্ঠা : ১৭০-১৮৫