সমাজবিজ্ঞান
‘Sociology’ শব্দটি এসেছে Latin শব্দ ‘Socius’ এবং ‘Logos’ থেকে। ‘Socius’ কথাটির অর্থ হল ‘Society’ (সমাজ) এবং ‘Logos’ শব্দটির অর্থ হল ‘Science’ (বিজ্ঞান)। সুতরাং ‘Sociology’ কথার আক্ষরিক অর্থ হল ‘Science of Study’.
সমাজবিজ্ঞান বা সমাজবিদ্যা বা সমাজতত্ত্ব মানুষের সমাজ বা দলের বৈজ্ঞানিক আলোচনা শাস্ত্র। এতে সমাজবদ্ধ মানুষের জীবনের সামাজিক দিক এবং তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করা হয়। অগাস্ট কোঁৎ- এর Positive Philosophy গ্রন্থে প্রথম Sociology শব্দটি ব্যবহৃত হয়।
Max Weber, এর মতে- সমাজবিদ্যা বা সমাজতত্ত্ব হল এমন একটি বিজ্ঞান যা সামাজিক কাজের উদ্ভাসনমূলক অনুধাবনের চেষ্টা করে যাতে সামাজিক কাজের গতি ও ফলাফলের কারণভিত্তিক ব্যাখ্যা প্রদান করা যায়।
ম্যাকাইভার ও পেজ, এর মতে- সমাজবিদ্যা হল মানুষের সাথে মানুষের সামাজিক সম্পর্ক ও সামাজিক সম্পর্কের জালিকা বিস্তার নির্ধারণকারী শাস্ত্র।
According to Duncan, Sociology is the scientific study of dynamic process of the interaction of person.
সুতরাং, উপরিউক্ত সংজ্ঞাগুলি বিশ্লেষণে বলা যায়, সমাজের মধ্যেকার ব্যাক্তির সম্পর্ক, পারস্পরিক বোঝাপড়া এবং গোষ্ঠীর কার্যাবলী নিয়ে যে শাস্ত্রে আলোচনা করা হয়ে থাকে, তাই হল সমাজবিজ্ঞান (Sociology)।
শিক্ষাশ্রয়ী সমাজবিজ্ঞান (Educational Sociology)
শিক্ষাবিজ্ঞান হল এমন একটি প্রক্রিয়া যা মানুষের আচরণ ধারায় পরিবর্তন আনে এবং পরিবর্তনশীল পরিবেশের সাথে অভিযোজনে সহায়তা করে। সামাজিক পরিবেশেরই একটি প্রধানতম উপাদান হলো মানুষ। সমাজের মধ্যে প্রত্যেকটি মানুষের পারস্পরিক বোঝাপড়ার মধ্যেদিয়ে উপলব্ধি করতে শেখে এবং সেই উপলব্ধির মধ্যে দিয়ে তার বোধের বিকাশ হয়। সমাজ এবং ব্যক্তির পারস্পরিক বোঝাপড়ার মধ্যে দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় একটি নির্দিষ্ট বিষয়সূচি এবং বিষয়জ্ঞান, যাকে বলা হয় শিক্ষাশ্রয়ী সমাজবিজ্ঞান (Educational Sociology)।
শিক্ষাবিজ্ঞান এবং সমাজতত্ত্ব হল দুটি পৃথক বিষয় বা শাখা। তবে আধুনিক সমাজতাত্ত্বিকদের মধ্যে সকলেই যে শিক্ষা সমাজতত্ত্ব আর শিক্ষাশ্রয়ী সমাজতত্ত্বের পার্থক্যকে গুরুত্ব দিয়েছেন তা বলা যায় না। যারা দুটি বিষয়কে পৃথক বলে মনে করেন , তারা এর কিছু পার্থক্য নির্দেশ করেছেন যা শুধুমাত্র এর গুরুত্বের ভিত্তিতে।
শিক্ষা ও সমাজতত্ত্ব মিলিতভাবে যে বিদ্যা চর্চার সূচনা করেছিল উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে তার তিনটি ভিন্ন অভিমুখ দেখা যায়। যথা,-
- শিক্ষার সমাজতাত্ত্বিক ভিত্তি (Sociological Foundation and Education)
- শিক্ষাশ্রয়ী সমাজতত্ত্ব (Educational Sociology)
- শিক্ষা সমাজতত্ত্ব (Sociology of Education)
শিক্ষাশ্রয়ী সমাজতত্ত্বের সংজ্ঞা হিসাবে বিভিন্ন সমাজতাত্ত্বিকদের বক্তব্য, শিক্ষার প্রশাসন ও প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে সমাজতত্ত্বের সাধারণ নীতি ও সিদ্ধান্তসমূহের প্রয়োগ। এই অভিমুখ অনুযায়ী শিক্ষাকে একটি স্বতন্ত্র সামাজিক একক হিসাবে গণ্য করে সমাজতাত্ত্বিক নীতির প্রয়োগ করা হয়েছে।
Ottaway-এর মতে, শিক্ষাশ্রয়ী সমাজতত্ত্ব সমাজবিজ্ঞানের এমন একটি শাখা যেখানে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহারে মাধ্যমে সামাজিক বিষয়ের অধ্যয়ন করা হয়।
অধ্যাপক Brown বলেছেন, শিক্ষাশ্রয়ী সমাজতত্ত্ব ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যে যে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে তা বুঝতে সাহায্য করে।
Cook & Cook এর মতে, পার্থিব বিষয়বস্তু এবং মানবিক-সম্পর্কের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানের জন্য সমাজবৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও কৌশলের যে প্রয়োজন তাই হল শিক্ষাশ্রয়ী সমাজতত্ত্ব।
George Payne, “By educational sociology we mean that, the science which describes and explains the institutions, social groups and social processes, that is the social relationship in which and through which the individual gains and organizes his experience.”
সুতরাং শিক্ষাশ্রয়ী সমাজতত্ত্ব সম্পূর্ণ সমাজতত্ত্বের একটি বিশেষ দিক যা সামাজিক পটভূমিকায় শিক্ষা প্রক্রিয়ার গঠনগত ও গতিশীল বিষয়গুলি আলোচনা করে।
শিক্ষাশ্রয়ী সমাজবিজ্ঞানের প্রকৃতি (Nature of Educational Sociology)
শিক্ষাবিজ্ঞান ও সমাজতত্ত্ব পরস্পর মিলিত ভাবে তৈরি হয়েছে শিক্ষাশ্রয়ী সমাজতত্ত্ব। এই শিক্ষাশ্রয়ী সমাজতত্ত্বের স্বরূপ বা প্রকৃতি নির্ণয়ে আমরা দেখতে পাই শিক্ষাবিজ্ঞান ও সমাজতত্ত্ব একে অপরের দ্বারা পরিপূর্ণ ও পরিপুষ্ট হয়ে গড়ে ওঠে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষামূলক সমাজতত্ত্বের প্রকৃতি নির্ণীত হয়।
Young বলেছিলেন, মানুষের পারস্পরিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করে শিক্ষামূলক সমাজতত্ত্ব। তাই শিক্ষাবিজ্ঞান সমাজতত্ত্বের প্রয়োগগত শাখারূপে তৈরি করেছে শিক্ষামূলক সমাজতত্ত্ব।
শিক্ষাশ্রয়ী সমাজতত্ত্বের প্রকৃতিগত দিক হলো সামাজিক মিথস্ক্রিয়া। অর্থাৎ সমাজজীবনে সামাজিক গোষ্ঠী, সামাজিক প্রতিষ্ঠান, সামাজিক সম্পর্ক এবং সামাজিক যোগাযোগ ব্যবস্থার সাপেক্ষে যথার্থ সামাজিকীকরণে উন্নত করে তোলা। এই জন্য সমাজতত্ত্ব দিয়েছে তত্ত্ব এবং তথ্য ও শিক্ষাবিজ্ঞান দিয়েছে নীতি ও কৌশল। এই দুয়ের মিলিত প্রবাহে তৈরি হয়েছে শিক্ষাশ্রয়ী সমাজতত্ত্ব। তার ফলে সমাজ , শ্রেণি , মানুষ , গৃহ থেকে বিদ্যালয় বিদ্যালয় , বিদ্যালয় থেকে মহাবিদ্যালয় এবং মানুষের কর্মক্ষেত্রে সবই সুষম বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে এবং সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ন্যায়বিচার ও ন্যায়বোধ , বিচার ব্যবস্থা , সমান অধিকার , সকল ক্ষেত্রেই সম সুযোগ এবং পারস্পরিক মেলবন্ধন।
শিক্ষাশ্রয়ী সমাজবিদ্যার যে সকল প্রকৃতি দেখা যায়, তা নিম্নে উল্লেখ করা হল-
- প্রয়োগমূলক শাখা: সমাজবিদ্যার একটি প্রয়োগমূলক শাখা হল শিক্ষাশ্রয়ী সমাজবিদ্যা। শিক্ষাক্ষেত্রে সমাজবিদ্যার নীতি ও পদ্ধতির বৈজ্ঞানিক প্রয়োগ ঘটে।
- শিক্ষা ও সমাজের সম্পর্ক: শিক্ষার সাথে সমাজের যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে, তা নিয়ে শিক্ষাশ্রয়ী সমাজবিদ্যা আলোচনা করে থাকে।
- সমাজের অগ্রগতি ও উন্নয়ন: শিক্ষাশ্রয়ী সমাজবিদ্যার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রকৃতি হল শিক্ষার মাধ্যমে সমাজের উন্নয়ন, অগ্রগতি ও বিকাশ সাধন।
- সামাজিক প্রক্রিয়ার প্রয়োগ: শিক্ষাশ্রয়ী সমাজবিদ্যার সাহায্যে শিক্ষাক্ষেত্রে যথাযথভাবে সামাজিক প্রক্রিয়াগুলির সঠিক প্রয়োগ করা সম্ভব হয়ে থাকে।
- ব্যাক্তি ও সমাজের মধ্যে সমন্বয় সাধন: শিক্ষাক্ষেত্রে সমাজবিদ্যার নীতি ও পদ্ধতির প্রয়োগের মাধ্যমে ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যে সঙ্গতিপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপিত হয়ে থাকে।
সেহেতু, শিক্ষা ও সমাজ তত্ত্বের আদর্শে তৈরি হয়েছে নানারকম সামাজিক প্রতিষ্ঠান যথা- বিদ্যালয়, ক্লাব, ধর্মীয় সংস্থা, সাংস্কৃতিক সংস্থা ও ক্রীড়া সংস্থা। এবং এগুলির মধ্যেদিয়ে ব্যাক্তিদ্বয়ের সামাজিক সম্পর্ক, সামাজিক পরিবর্তনশীলতা, সামাজিক অগ্রগতি, সামাজিক প্রক্রিয়া এবং সামাজিক সংগঠনে প্রযুক্ত হয়েছে বিজ্ঞান চেতনার সুষম প্রগতি সাধিত হয়ে থাকে।
শিক্ষাশ্রয়ী সমাজবিজ্ঞানের পরিধি (Scope of Educational Sociology)
শিক্ষা বিজ্ঞান ও সমাজতত্ত্ব পরস্পর যুক্ত হয়ে ব্যক্তি ও সমাজের মঙ্গল সাধনে অগ্রসর হয়েছে এবং সমাজ ও ব্যক্তির মধ্যে সুস্থ ও সঙ্গতিপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেছে। বিভিন্ন সমাজবিদ্ বিভিন্নভাবে এবং আঙ্গিকে সমাজকে ব্যাখ্যা করেছেন, তাঁদের সেই বক্তব্যগুলি বিশ্লেষণে শিক্ষাশ্রয়ী সমাজতত্ত্বের পরিধি সুস্পষ্ট হয়। যেমন –
- ব্যাক্তির জন্ম থেকে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত জীবন বিকাশের প্রত্যেক স্তরে শিক্ষাশ্রয়ী সমাজবিজ্ঞান প্রভাব বিস্তার করে।
- জনসমষ্টি দেশের অন্যতম সম্পদ যার দ্বারা একদিকে যেমন সুস্থ সমাজ তৈরি হয় ও অন্যদিকে তৈরি হয় যথার্থ শিক্ষাব্যবস্থা। তাই শিক্ষাশ্রয়ী সমাজতত্ত্বের পরিধির অন্যতম উপকরণ হলো জনসমষ্টি ও তার প্রকৃতিগত উন্নয়ন সংস্থা এবং প্রকৃতিগত উন্নয়ন হল সমস্যা এবং প্রগতিগত উন্নয়ন হল অভিমুখী শিক্ষাভাবনা।
- শিক্ষাশ্রয়ী সমাজতত্ত্বের অপর একটি পরিধিভুক্ত বিষয় হলো সামাজিক মিথস্ক্রিয়া। যার দ্বারা মানুষ দল গঠন করে এবং পারস্পরিক সংগতি বিধান করে। তাই মিথস্ক্রিয়ার প্রকৃতি প্রক্রিয়ার প্রকার সম্পর্কে আলোচনা করে এই বিষয়।
- বর্তমানকালে বিভিন্ন সাম্প্রতিক সমস্যা, যেমন- বেকারত্ব, দারিদ্র্যতা, নিরক্ষরতা, ধর্মীয় বিভেদ ইত্যাদির মত সামাজিক সমস্যাগুলির উপর গুরুত্ব আরোপ করে থাকে।
- সকল ব্যবস্থাপনার মূলে যে সম্পদ সেটি হল মানবসম্পদ। সুতরাং মানবসম্পদের প্রকৃতিগত দিক বিশ্লেষণ এই শাখার গুরুত্বপূর্ণ পরিধিযুক্ত বিষয়।
- শিক্ষাশ্রয়ী সমাজতত্ত্বের পরিধি হল সামাজিক গঠন। সমাজ গঠনের প্রকৃতি, নিয়ম, রীতিনীতি, গোষ্ঠীচেতনা প্রভৃতি সম্পর্কে আলোচনা করে এই বিষয়টি।
- আধুনিক গতিশীল সমাজব্যবস্থায় শিক্ষকের ভূমিকা, কার্যাবলী সম্বন্ধেও এই শাস্ত্রে আলোচনা করা হয়ে থাকে।
- সামাজিক দল ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সর্বোপরি গোষ্ঠীজীবনের বৈশিষ্ট্য, প্রকৃতি এবং তাৎপর্য আলোচনা করে শিক্ষাবিজ্ঞানের সাপেক্ষে।
শিক্ষামূলক সমাজবিজ্ঞান জীবনবিকাশের এবং শিক্ষার বিভিন্ন ক্ষেত্রে তার প্রভাব বিস্তার করেছে। মানবজীবনের বিকাশ সাধনে শিক্ষাশ্রয়ী সমাজবিজ্ঞান গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। শিক্ষাশ্রয়ী সমাজবিজ্ঞান আমাদের সামাজিক মূল্যবোধ গুলি আয়ত্ত করতে সহায়তা করে থাকে, এর ফলে একজন সাধারণ মানুষ সামাজিকজীবে পরিণত হয়ে থাকে।
সমাজবিজ্ঞান ও শিক্ষার সম্পর্ক
শিক্ষা এবং সমাজ :
লৌকিক অর্থে শিক্ষা হল জ্ঞান অর্জন করা। জ্ঞান সঞ্চয়ের ফলে ব্যক্তির মানসিক শক্তিগুলির উৎকর্ষণ ঘটে—এ ধারণা প্রাচীনকালে অনেকের মধ্যেই বদ্ধমূল ছিল। কিন্তু শিক্ষার এই ধারণার সঙ্গে বাস্তব জীবন অথবা সামাজিক পরিবেশের কোনো সম্পর্ক ছিল না। তাই পরবর্তীকালে শিক্ষাবিদ ও চিন্তাবিদগণ শিক্ষার ধারণা সম্পর্কে নতুন মত পোষণ করলেন। তাঁরা বললেন—শিক্ষা ও জীবন দুটি আলাদা বস্তু নয়। জীবনই শিক্ষা, শিক্ষাই জীবন। সমস্ত জীবন ধরেই মানুষ শিখে থাকে। অন্যান্য জীবের মতো মানুষের পুষ্টিকর খাদ্যে দেহের বৃদ্ধি ঘটে ও বংশরক্ষা হয়। ঠিক তেমনি শিক্ষা দ্বারা তার মানসিক বৃদ্ধি ও বিকাশ ঘটে এবং তার সমাজজীবন বংশপরম্পরায় সন্তান-সন্ততির মধ্যে সঞ্চারিত হয়, সমাজ ও সংস্কৃতির ধারাকে বজায় রাখে।
আবার, এই সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ নিয়তই পরিবর্তিত হচ্ছে। ফলে মানুষের জীবনযাপন প্রণালী ও ধ্যানধারণার পরিবর্তন হচ্ছে। তারই পরিণতি হল সামাজিক রীতিনীতি, আচার-অনুষ্ঠান, ধর্মীয় ধ্যানধারণার পরিবর্তন। কাজেই এই নিয়ত পরিবর্তনশীল সামাজিক পরিবেশে ব্যক্তির সার্থক অভিযোজন বিশেষ ভাবে দরকার। শিক্ষাবিদ হর্নি (Horney) তাই বলেছেন – শিক্ষা হল মানুষের প্রকৃতির সঙ্গে, সমাজের মানুষের সঙ্গে এবং সমগ্র বিশ্ব প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গতি বিধান প্রক্রিয়া (Education should be thought of as the process of man’s adjustment to his nature, to his fellows and to the ultimate nature of cosmos)।
সমাজ ও শিক্ষা :
শিক্ষা একটি ব্যক্তিগত প্রক্রিয়া। কিন্তু এই প্রক্রিয়া সমাজের পটভুমিতেই সম্ভব। ব্যক্তি জন্মগ্রহণ করে সমাজভুক্ত পরিবারে। তার বুদ্ধি, কর্ম, আচার-আচরণ তথা ব্যক্তিত্বের স্ফুরণ ঘটে সমাজের মধ্যেই। সমাজের সঙ্গে ব্যক্তির ঘনিষ্ঠ বন্ধন। সমাজচেতনা, ব্যক্তির সহজাত প্রবৃত্তি সামাজিক পরিবেশের সঙ্গে ব্যক্তির সঙ্গতিবিধানের মাধ্যমেই সংঘটিত হয়, যার বাস্তবায়নে শিক্ষা হয় ফলপ্রদ। ব্যক্তির চাহিদা যেভাবে শিক্ষাকে নিয়ন্ত্রণ করে, সামাজিক চাহিদাও সেভাবে শিক্ষার মধ্যে পরিতৃপ্তি খোঁজে এবং প্রতিষ্ঠালাভ করতে চায়।
সমাজের সৃষ্টি মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি থেকে হলেও সমাজ-সংরক্ষণ, সামাজিক প্রগতি মানুষের শিক্ষার ওপরেই নির্ভরশীল। সমাজের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন রীতিনীতি, আচার-অনুষ্ঠান, প্রথা প্রভৃতি দেখা দেয়। শিশু এগুলির সঙ্গে পরিচিত না হলে কিংবা তা মেনে না চললে সমাজের সংহতি বিনষ্ট হয়। সামাজিক বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। শিশুকে তাই সমাজ জীবনের উপযোগী করে গড়ে তোলা একান্ত প্রয়োজন— যা শিক্ষার দ্বারাই সম্ভব।
সামাজিক স্থিতি ও সংগতিবিধানই শিক্ষার একমাত্র লক্ষ্য নয়। সমাজ সংরক্ষণও শিক্ষার উদ্দেশ্য। সমাজের বংশধরেরাই সমাজকে বাঁচিয়ে রাখে। শিক্ষায় সমাজের এই ধারাকে স্থান না দিলে প্রবহমান জলস্রোতে সমাজ কখনোই স্থায়ী হতে পারে না।
শিক্ষায় আমরা শিক্ষার্থীর ব্যক্তিত্ব বিকাশের ওপর গুরুত্ব দিই। সমাজ পরিবেশ থেকে ব্যক্তি নানা উপাদান সংগ্রহ করে। ব্যক্তিত্ব ও সমাজবোধ—অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পর্কযুক্ত। ব্যক্তিছাড়া যেমন সমাজের অস্তিত্ব থাকে না, তেমনই সমাজ ছাড়াও ব্যক্তিকে কল্পনা করা যায় না। জন্মের পরই ব্যক্তি, সমাজজীবনের আচার অনুষ্ঠান, রীতিনীতি ইত্যাদির সঙ্গে স্বাভাবিক ভাবেই জড়িয়ে পড়ে। ফলে তার মধ্যে বিকশিত হয় সামাজিক সত্তা (Social self), অহংবোধ। ব্যক্তি উন্নীত হয় সামাজিক সত্তায়। তাই শিক্ষা তথা জীবন অভিজ্ঞতা সংগ্রহে সামাজিক পরিবেশের প্রভাব বিশেষ ভাবে লক্ষণীয়।
আধুনিক সমাজ শিক্ষাকে একটি সামাজিক শক্তি ও সমাজের প্রগতি, আধুনিকীকরণ ইত্যাদির। মাধ্যম স্বরূপ গণ্য করে। তাই শিক্ষার আধুনিক বৈশিষ্ট্য হল—এটি একটি সামাজিক শক্তি বা Social force । শুধু জ্ঞান ও সংস্কৃতির সঙ্গে সঞ্চিত ভাবধারার পরিচিতি ঘটানোই শিক্ষার স্বরূপ নয়, সামাজিক নবীকরণ বা আধুনিকীরণ ও প্রগতির উপকরণ হল শিক্ষা। কারণ, কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন তখনই সম্ভব, যখন বৈজ্ঞানিক এবং কারিগরি শিক্ষা প্রসারের দ্বারা দেশকে জীবনের অস্তিত্ব সংরক্ষণে স্বনির্ভর করা যাবে। সে জন্য প্রয়োজন শিক্ষার ক্ষেত্রে আধুনিকীকরণ ও সমাজের অগ্রগতিতে তার যথাযথ প্রয়োগ। সুতরাং দেখা যায়, ব্যক্তি, সমাজ ও শিক্ষা নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত এবং একে অপরের উপর নির্ভরশীল। এদিক থেকে বলা চলে, সমাজ তথা ব্যক্তির অগ্রগতিতে শিক্ষার ভূমিকা অপরিসীম ও অপরিহার্য
গ্রন্থপঞ্জি-
- চট্টরাজ, অধ্যাপক শ্যামাপ্রসাদ। শিক্ষামুখী সমাজবিজ্ঞান। সেন্ট্রাল লাইব্রেরী। পৃষ্ঠা : ১-২৮
- পাল, ড. দেবাশিস। শিক্ষার সমাজতাত্ত্বিক ভিত্তির রূপরেখা। রীতা বুক এজেন্সি। পৃষ্ঠা : ১-৩৫
- তরফদার, ড. মঞ্জুষা। শিক্ষাশ্রয়ী সমাজবিজ্ঞান। কে. চক্রবর্তী পাবলিকেশনস্। পৃষ্ঠা : ১-২০
- চক্রবর্তী, ড. সোনালী। শিক্ষার সমাজ বৈজ্ঞানিক ভিত্তি। সোমা বুক এজেন্সি। পৃষ্ঠা : ২৯-৪৮
- ভট্টাচার্য, দিব্যেন্দু। শিক্ষা ও সমাজতত্ত্ব। পিয়ারসন। পৃষ্ঠা : ১-৮
- ঘোড়াই, নিমাই চাঁদ। শিক্ষাদর্শন ও সামাজিক শিক্ষা। সাঁতরা পাবলিকেশন প্রা. লি.। পৃষ্ঠা : ২৫১-২৫৩
___________________________