Kd's e-pathsala Educational Sociology সামাজিক গোষ্ঠীর ধারণা, সংজ্ঞা, বৈশিষ্ট্য এবং শ্রেণিবিভাগ

সামাজিক গোষ্ঠীর ধারণা, সংজ্ঞা, বৈশিষ্ট্য এবং শ্রেণিবিভাগ



 

মানুষ হল সমাজবদ্ধ জীব। সভ্যতার আদিপর্বে মানুষ একাকি জঙ্গলে, গুহায়, নদী উপত্যকায় বসবাস করতো। কিন্তু যে দিন থেকে তারা অনুভব করলো যে, একাকি বা বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস মোটেই সুবিধাজনক নয়। এক্ষেত্রে জন্তু-জানোয়ারের আক্রমণ কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে মোকাবিলা করা কঠিন, সেদিন থেকে মানুষ একত্রিত হয়ে বসবাস শুরু করলো, সেদিন থেকে জন্ম হল গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজের এবং জীবন প্রবাহের সাথে সাথে এতে আসে নানান পরিবর্তন জন্ম হয় দল, প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন সংস্থার। মানুষের জীবনে এই ধারনা প্রথমে গৃহে, খেলার মাঠ, বিদ্যালয় থেকে কর্মক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়ে। একজন ব্যাক্তির জীবনে পূর্ণতা আসে এই সকল সামাজিক সংগঠন থেকে, এই সকল সামাজিক সংগঠন গুলিকেই সাধারণত “গোষ্ঠী” বলা হয়ে থাকে।

 

 

সামাজিক গোষ্ঠীর সংজ্ঞা

বিভিন্ন সমাজতাত্ত্বিক বিভিন্ন আঙ্গিকে সামাজিক গোষ্ঠীর সংজ্ঞা প্রদান করেছেন, যেগুলি নিম্নে উল্লেখ করা হল-

অধ্যাপক জিসবার্ট এর মতে, সামাজিক গোষ্ঠী এমন কতগুলি ব্যাক্তির সমষ্টি যারা একটি স্বীকৃত সংগঠনের মধ্যে পরস্পর ক্রিয়াশীল থাকে।

অধ্যাপক ম্যাকাইভার ও পেজ, “গোষ্ঠী” শব্দটিকে ব্যপক অর্থে ব্যবহার করেছেন। তাঁরা পরস্পরের সঙ্গে সামাজিক বন্ধনে আবদ্ধ যে কোন মানব সমষ্টিকে গোষ্ঠী বলেছেন।

According to Professor T. B. Bottomore, “A social group may be defined as an aggregate of individuals in which- 1. Defined relations exists between the individuals comprising it and, 2. each individual is conscious of the group itself and its symbol”. 

 

সামাজিক গোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য

সামজিক গোষ্ঠীর সংজ্ঞাগুলি বিশ্লেষণে এর কতকগুলি বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়, যেগুলি উল্লেখ করলে হয়তো সামাজিক গোষ্ঠীর ধারনা আরও পরিস্ফুট হবে। সামজিক গোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্যগুলি হল-

  1. গোষ্ঠীর প্রধানতম বৈশিষ্ট্য হল এদের মধ্যেকার পারস্পরিক সম্পর্ক। “আমরা মনোভাব”, এই প্রকার মানসিক চেতনাই হল গোষ্ঠীর মূল ভিত্তি।
  2. গোষ্ঠীর আরও একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল- “অখণ্ডতার চেতনা” (A sense of belongingness)।
  3. পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া (মিথস্ক্রিয়া) গোষ্ঠীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
  4. সামাজিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ এবং অন্যকে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করা।
  5. নিজ আত্মকেন্দ্রিকতা থেকে বেড়িয়ে এসে গোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষায় সচেষ্ট হওয়া।
  6. নিজেদের মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে সমাজের উন্নতি সাধন।
  7. সামাজিক গোষ্ঠী সংস্কৃতির ধারক ও বাহক।
  8. সামাজিক গোষ্ঠী মানুষের আশা-আকাঙ্খা পূরণ করে থাকে।
  9. গোষ্ঠী তার মধ্যেকার সদস্যদের মধ্যে দলীয় মনোভাব সঞ্চার করে।
  10. সামাজিক গোষ্ঠী ব্যাক্তির উন্নত চরিত্র গঠনে সহায়ক।

উপরিউক্ত সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্যগুলি বিশ্লেষণে বলা যেতে পারে যে, একাধিক ব্যাক্তি নিয়ে গঠিত একটি সংগঠন, যেখানের সদস্যরা পারস্পরিক মিথক্রিয়ায় রত থাকেন এবং একে অপরের মধ্যে সামাজিক অনুভূতির সঞ্চার করে থাকে, এরূপ সংগঠনকেই সামাজিক গোষ্ঠী বলে

 

 

সামজিক গোষ্ঠীর তাৎপর্য

সামজিক গোষ্ঠী হল সংস্কৃতির ধারক ও বাহক, সভ্যতার সূচনা লগ্নে যে সমাজ গঠন হয়েছিল, তার সুষ্ঠু বিকাশের জন্য কিছু নিয়ম-কানুনও তৈরি হয়। এই নিয়ম-কানুন লিখিত অবস্থায় থাকে না, এটি মৌখিকভাবে এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে সঞ্চারিত হয়, যাকে আমরা বলি Cultural Transmission। এই সংস্কৃতির সঞ্চার ও তার সংরক্ষণের ক্ষেত্রে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে গোষ্ঠী। সামাজিক গোষ্ঠী সর্বদাই গোষ্ঠীর মধ্যেকার সদস্যদের নিরাপত্তা প্রদান করে, তাদের স্বার্থরক্ষা করার চেষ্টা করে এবং তাদের আশা-আকাঙ্খা পূরণেও নানান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। সামাজিক গোষ্ঠী প্রত্যেক সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে সমাজের মধ্যেকার সকল মানুষের মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলে। গোষ্ঠী ব্যাক্তিকে গণতান্ত্রিক আদর্শে উদ্বুদ্ধ করে, তার চরিত্র গঠন করে এবং একজন পরিপূর্ণ সামাজিক জীব হয়ে উঠতে সহায়তা করে।

 

 

সামাজিক গোষ্ঠীর শ্রেণিবিভাগ

সামাজিক গোষ্ঠীর শ্রেণিবিভাগ নিম্নে একটি চিত্রের মাধ্যমে দেখানো হল-

সামাজিক সম্পর্ক ও পারস্পরিক নৈকট্যের ভিত্তিতে মার্কিন সমাজতত্ত্ববিদ C. H. Cooley তাঁর “Social Organisation” (1990) গ্রন্থে এই দুই শ্রেণীর সামাজিক গোষ্ঠীর কথা উল্লেখ করেন।নিম্নে এই দুই গোষ্ঠী সম্বন্ধে বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হল, এছাড়াও তাৎক্ষনিক গোষ্ঠীর ধারণাও নিম্নে উল্লেখ করা হল –

 

প্রাথমিক গোষ্ঠী (Primary Group)       

এই প্রকার গোষ্ঠী পারস্পরিক প্রত্যক্ষ সম্পর্কের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে। এই প্রকার গোষ্ঠীকে পারস্পরিক চরম অন্তরঙ্গতা ভিত্তিক সংগঠন হিসাবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। অধ্যাপক কুলি, প্রাথমিক গোষ্ঠীকে একান্ত প্রাথমিক বলেছেন কারণ এটি মানুষের সামাজিক প্রকৃতি ও আদর্শ গঠনে মৌলিক ভূমিকা পালন করে। এখানে পারস্পরিক একাত্মতায় “আমরা”-বোধ জাগ্রত হয়।

 

        এই প্রকার গোষ্ঠীর বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। যথা-

  1. এই প্রকার গোষ্ঠীর সদস্যদের মধ্যেকার পারস্পরিক অন্তরঙ্গতা অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ।
  2. এই প্রকার গোষ্ঠীকে “face to face group” ও বলা হয়, কারণ এদের মধ্যে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক পরিলক্ষিত হয়।
  3. এই প্রকার গোষ্ঠীর আয়তন খুবই ক্ষুদ্র।
  4. এই প্রকার গোষ্ঠীর স্থায়িত্ব অপেক্ষাকৃত বেশী।
  5. এই প্রকার গোষ্ঠীর প্রত্যেক সদস্যরা একে অপরের প্রতি সমানভাবে দায়বদ্ধ।
  6. প্রাথমিক গোষ্ঠী কোন প্রকার চুক্তির উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে না।
  7. প্রাথমিক গোষ্ঠীর মধ্যে “আমরা বোধ” বা we feeling পরিলক্ষিত হয়।  

      

গৌণ গোষ্ঠী (Secondary Group)

পূর্বোক্ত ছোট ছোট গোষ্ঠী ভিন্ন সমাজে যেসব বড় বড় গোষ্ঠী আছে ও যাদের মধ্যে সাধারণ গোষ্ঠীচেতনা ও চেতনা উদ্ভূত একটি ঐক্যবোধ আছে, কিন্তু ব্যাক্তিদের পরস্পরের মধ্যে সম্পর্ক ততটা প্রতক্ষ ও ঘনিষ্ঠ নয় ও এদের মধ্যে মুখোমুখি পরিচয় নাও থাকতে পারে, এদের মাধ্যমিক গোষ্ঠী বা গৌণ গোষ্ঠী বলে। অধ্যাপক ডেভিস এর মতে, গৌণ গোষ্ঠীগুলি প্রাথমিক গোষ্ঠীর সম্পূর্ণ বিপরীত। এখানে সদস্যরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন। এখানে সদস্যদের সম্পর্ক নৈব্যাক্তিক ও ক্ষণস্থায়ী।

 

        এই প্রকার গোষ্ঠীর বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। যথা-

  1. এই গোষ্ঠীগুলি সাধারণত অর্থনৈতিক অবস্থা ও স্বার্থের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে।
  2. এই গোষ্ঠীগুলির আয়তন প্রাথমিক গোষ্ঠী অপেক্ষা বৃহৎ।
  3. এই গোষ্ঠীগুলির সম্পর্ক অনেকটা নৈব্যাক্তিক, পরোক্ষ ও বাহ্যিক।
  4. গৌণ গোষ্ঠীর স্থায়িত্ব অনেক বেশী।
  5. গৌণ গোষ্ঠীর পারস্পরিক সম্পর্ক চুক্তিনির্ভর।
  6. পরোক্ষ সহযোগিতা গৌণ গোষ্ঠীগুলির বৈশিষ্ট্য।
  7. গৌণ গোষ্ঠীগুলিতে সদস্যদের আনুগত্য লাভের জন্য এবং সংগঠনের সংহতি রক্ষার জন্য যে নিয়ন্ত্রণ প্রয়োগ করা হয় তা বিধিবদ্ধ, পরোক্ষ এবং নৈব্যাক্তিক।
  8. গৌণ গোষ্ঠীগুলি ব্যাক্তির মধ্যে সামাজিক গুণাবলি বিকাশে সাহায্য করে।

 

স্বল্পস্থায়ী বা তাৎক্ষণিক গোষ্ঠী (Tertiary Group)

সমাজে হঠাৎ হঠাৎ এমন কিছু জনসমাগম হয় যা তাৎক্ষণিক গোষ্ঠী বা স্বল্পস্থায়ী গোষ্ঠী নামে পরিচিত, এখানে সদস্যদের মধ্যে কোনো প্রত্যক্ষ সম্পর্ক থাকে না। কিন্তু সদস্যরা কোন একটা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যের পরিপ্রেক্ষিতে একসাথে জমায়েত হয়। আবার উদ্দেশ্যপূরণ হয়ে গেলে পর জমায়েত সরে যায়, একেই স্বল্পস্থায়ী গোষ্ঠী বা Tertiary Group বলা হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়- বাস বা ট্রেন যাত্রী, যাত্রা, অ্যাক্সিডেন্ট-এর সময় ভিড়, লিফটে চলাচলকারি লোকজন, জনসভা  ইত্যাদি।
 

 গ্রন্থপঞ্জি-

  • চট্টরাজ, অধ্যাপক শ্যামাপ্রসাদ। শিক্ষামুখী সমাজবিজ্ঞান। সেন্ট্রাল লাইব্রেরী, পৃষ্ঠা : ৮৮-১০৬
  • তরফদার, ড. মঞ্জুষা। শিক্ষাশ্রয়ী সমাজবিজ্ঞান। কে. চক্রবর্তী পাবলিকেশনস্, পৃষ্ঠা : ৪৮-৬৫
  • চক্রবর্তী, ড. সোনালী। শিক্ষার সমাজ বৈজ্ঞানিক ভিত্তি। সোমা বুক এজেন্সি, পৃষ্ঠা : ৮৮-১০৬

 _________________________________

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *