আমরা সকলেই জানি যে, গতানুগতিক মূল্যায়ন ব্যবস্থায় নম্বরদানের প্রথা প্রচলিত, কিন্তু আধুনিককালে এই পদ্ধতি ভীষণভাবে সমালোচিত হচ্ছে। এই ভুল ত্রুটিগুলিকে দূর করার জন্য আধুনিক মূল্যায়ন ব্যবস্থায় গ্রেডিং প্রথার প্রচলন করা হয়েছে। ইংরেজি “Grading” কথাটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ “Gradus” থেকে এসেছে। এর অর্থ হল “Step”, গ্রেডিং এমন একপ্রকার মূল্যায়ন পদ্ধতি যা বিষয়গুলির পূর্বকথিত মান অনুযায়ী বিবেচিত হয়। এতে কিছু প্রতীক থাকে, যা একজন শিক্ষার্থীর সম্পাদনী ক্ষমতার সূচক। এছাড়া এতে যুক্ত কিছু চিহ্ন শিক্ষক এবং অভিভাবকদের নিকট স্পষ্টভাবে শিক্ষার্থীর পারদর্শিতাকে তুলে ধরে।
গ্রেডিং কথার দ্বারা নির্দিষ্ট স্তর অনুযায়ী মানের বিভাজনকে বোঝায়, এক্ষেত্রে এই প্রকার বিভাজন তখনই সম্ভব হবে যখন কোন ব্যাক্তি বা বস্তুর বিভিন্ন গুন সম্পর্কে যথাযথ বা স্পষ্ট ধারণা দেওয়া থাকবে। যেমন- কোন বিদ্যালয়ের প্রাপ্ত সুযোগ-সুবিধা কিংবা পারদর্শিতা কিংবা ছাত্রছাত্রীদের ফলাফলের ভিত্তিতে বিভিন্ন স্তরে ভাগ করে তাদের সাফল্যের সূচককে গ্রেড দ্বারা চিহ্নিত করা যেতে পারে, কিংবা ব্যাক্তিগতভাবে কোন ছাত্রের ফলাফলের সূচক হিসাবে। এক্ষেত্রে প্রত্যেক স্তরকে গ্রেড দ্বারা চিহ্নিত করাই হল গ্রেডিং। গ্রেডিং শিক্ষার্থীদের উত্তর পত্রকে নম্বর স্কেলে মূল্যায়ন করার পর বিভিন্ন নম্বর স্কেলে তাদের প্রাপ্ত নম্বরকে চিহ্নিত করার পদ্ধতি। শিক্ষার্থীদের প্রাপ্ত ফলটি উদ্দেশ্যসাধক পাঠ্যক্রমের উপর অর্জিত দক্ষতার প্রতিফলনের নির্দেশক। নম্বরও এক ধরনের গ্রেড। আন্তর্জাতিক স্তরে নম্বর গ্রেডের স্বীকৃত পরিমাপটি বা স্কেলটি হল 101 পয়েন্টের। বর্তমানে ভারতেও এই প্রথার সূচনা ঘটেছে, কিন্তু তা শুরু হয়েছে অন্যান্য দেশের তুলনায় পরে।
নম্বর দ্বারা পরীক্ষার্থীর পরিমাণগত মূল্যায়ন সম্ভব কিন্তু গুণগত মূল্যায়ন সম্ভব নয়, যা সম্ভব গ্রেডিং-এর দ্বারা। নম্বর অক্ষর গ্রেডে রুপান্তর করলেই তা বিশেষ সূচক বা নির্দেশকের কাজ করে। গ্রেডিং-এর মূল কথা হল গুণগত বিভাজন, ফলে প্রত্যেকটি গ্রেডের একটি গুণগত বর্ণনা আছে, যেমন- খুব ভালো, ভালো, মোটামুটি বা মাঝারি, খারাপ, খুব খারাপ ইত্যাদি। এই গুণগত বর্ণনাগুলিকে যখন পর্যায়ক্রমে ইংরেজি বর্ণমালার এক একটি অক্ষর দিয়ে চিহ্নিত করা হয়, যেমন- A, B, C, D, E এবং এই অক্ষরগুলি সার্বজনীনভাবে ভালো-খারাপ বিচারে গ্রেডের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। সুতরাং উপরিউক্তভাবে বিভাজন করতে পারলে, তবেই গ্রেডিং প্রথার মাধ্যমে মূল্যায়ন সম্ভব হবে।
গ্রেডিং পদ্ধতি (Procedure of Grading)
গ্রেডিং পদ্ধতি বর্তমানে বহুল প্রচলিত একটি পদ্ধতি, এখানে নম্বরদানের মত তাৎক্ষনিক প্রক্রিয়াতে শিক্ষার্থীর পারদর্শিতার বিচার করা হয় না। সাধারণত গ্রেডিং-এর ক্ষেত্রে যে সকল পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়ে থাকে, সেগুলি নিম্নে উল্লেখ করা হল-
১) Direct Grading:- গ্রেডিং-এর পদ্ধতিগুলির মধ্যে সবথেকে সহজ সরল পদ্ধতি হল সরাসরি গ্রেডিং (Direct grading)। এই পদ্ধতিতে পরীক্ষক একই প্রশ্নের সমস্ত পরীক্ষার্থীদের লেখা উত্তর একসঙ্গে পড়ে সেগুলিকে পাঁচটি বা সাতটি ভাগে ভাগ করে রাখেন। কোন উত্তর সম্বন্ধে সন্দেহ থাকলে তা দ্বিতীয়বার পড়ে সিধান্ত পরিবর্তন করতে পারেন। এবার সবচেয়ে ভালো উত্তরকে A তারপর B, C, D এইভাবে চিহ্নিত করলে বলা হবে ওই প্রশ্নের দরুন গ্রেডিং করা হল। যদি কখনও ওই গুলির মধ্যেও স্পষ্ট স্তর বিভাগ থাকে তবে একেকটি গ্রেডে উত্তরকে আবার দু’ভাগে ভাগ করা হবে A+, AB+, BC+, C এইভাবে গ্রেডিং করা যায়।
২) Separate Evaluation of each Answer:- এখানে প্রত্যেকটা প্রশ্ন আলাদাভাবে মূল্যায়ন হবে এর ফলে প্রধান পরীক্ষক বা পরবর্তীকালে যারা মূল্যায়ন করবেন তাদের সুবিধা হয়। প্রত্যেকটা গ্রেডে যে নম্বর দেওয়া থাকবে সেই গ্রেড গুলিকে যোগ করে গ্রেড পয়েন্ট গড় নির্ণয় করা হবে। নম্বরগুলি হল O=6, A=5, B=4, C=3, D=2, E=1, F=0
যিনি প্রশ্নের গ্রেড দেবেন বা যিনি খাতা দেখবেন তিনি প্রত্যেকটা প্রশ্নের গ্রেড দিয়ে প্রধান পরীক্ষকের কাছে পাঠিয়ে দেবেন। তিনি সব গ্রেডগুলো যোগ করে round off করে final grade দেবেন।
৩) Conversion of Marks into Grades:- এখানে গ্রেডের পরিবর্তে প্রথমে নম্বর দেওয়া হয়। ধরা যাক, পাস মার্ক 35, সর্বোচ্চ স্কোর 72, তা হলে গ্রেডটা এরকম হবে-
৪) Checking by means of Normal Distribution Curve:- এখানে শিক্ষার্থীদের সম্পাদন ক্ষমতাকে স্বাভাবিক সম্ভাবনার লেখচিত্রের দ্বারা গ্রেড দেয়া হয়, অর্থাৎ এখানে স্বাভাবিক সম্ভাবনার যে Z-স্কোর 66, তাকে 7 দিয়ে ভাগ করে একভাগে যত শতকরা করে হয় সেই অনুযায়ী গ্রেড করা হয়।
৫) Separate Indication of Internal and External Assessment:- অনেক সময় Internal এবং External Assessment-কে আলাদা আলাদাভাবে গ্রেড দিয়ে ওই গ্রেডগুলোকে পরবর্তীকালে যোগ করে শিক্ষার্থীর সম্পাদন-কে Weightage দিয়ে গ্রেড করা হয়।
৬) Weightage of Course Unit:- অনেক সময় কোর্স ইউনিটে আলাদা আলাদা গ্রেড দেওয়া হয়। যেমন- লেকচারের জন্য একরকমের গ্রেড, টিউটোরিয়াল, অ্যাসাইনমেন্ট ইত্যাদির জন্য আলাদা আলাদা গ্রেড দেওয়া হয়। পরে সেগুলো যোগ করে ফাইনাল গ্রেড দেওয়া হয়।
গ্রেডিং পদ্ধতির সুবিধা (Advantages of Grading)
- এই পদ্ধতির দ্বারা ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা দূর করা সম্ভব।
- এই পদ্ধতির দ্বারা শিক্ষকদের মূল্যায়নের কাজ সহজ হয়।
- নম্বর হেরফের এর সমস্যা থাকে না।
- গ্রেড পদ্ধতি যথার্থতা, নির্ভরযোগ্যতা ও নৈব্যক্তিকতার মান বহুগুন বাড়িয়ে দেয়।
- যে কোন ফলাফলের মূল্যায়ন ও তার সংরক্ষণ অনেক সহজ হয়।
- ছাত্রছাত্রীদের নম্বর বাড়ানোর যে পীড়ন সেখান হতে নিষ্কৃতি পাওয়া সম্ভব।
গ্রেডিং পদ্ধতির অসুবিধা (Disadvantages of Grading)
- এটি একটি জটিল প্রক্রিয়া।
- এর মাধ্যমে বাহ্যিক প্রেষণা সঞ্চারিত হয়, অভ্যন্তরীণ নয়।
- নম্বরের ধারণা মানুষের মনে এমনভাবে প্রবেশ করে গেছে যে, শুধু গ্রেডের দ্বারা তারা ফলাফলের তাৎপর্য অনুধাবন করতে পারে না।
- শিক্ষক যদি পারদর্শী না হন, তবে এই পদ্ধতির কোন সার্থকতা থাকে না।
- এর মান সর্বক্ষেত্রে সমান হয় না, বিশ্ববিদ্যালয় ভেদে পার্থক্য থাকে।
- এই পদ্ধতিতেও পক্ষপাতের ধারণাকে একেবারে দূর করা সম্ভব নয়।
- চক্রবর্তী, ড. প্রণব কুমার., পাল, ড. দেবাশিস., পাণ্ডে, প্রণয়। শিক্ষায় মূল্যায়ন এবং পরিমাপ। রীতা পাবলিকেশন, পৃষ্ঠা : ৫৫ – ৫৯
- পাল, ড. গোবিন্দ পদ., মিত্র, ড. গঙ্গারাম। শিক্ষায় মূল্যায়ন। নব প্রকাশনী, পৃষ্ঠা : ৫৫ – ৫৯
_________________________