সময়ের সাথে তালে তাল মিলিয়ে মানব সমাজ পরিবর্তন হয়, এই পরিবর্তনের সাথে আসে নানান জটিলতা। শিক্ষাকেও এর সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হয় নতুবা শিক্ষা তার প্রাসঙ্গিকতা হারাবে। শিক্ষা একটি জীবনমুখী প্রক্রিয়া এবং জীবনের তাই নানা সদাপরিবর্তনশীল অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধানের জন্য শিক্ষাকে বিভিন্নকালে ও দেশে পরিবর্তন করতে হয়।
UNO বা রাষ্ট্রসংঘের কতকগুলি শাখা সংগঠন আছে, যেগুলি সারা পৃথিবী বা বিশ্বের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গবেষণা, পরামর্শ ও কাজ পৃথিবীর মানুষের জন্য করে থাকে। এই সংগঠনগুলির মধ্যে অন্যতম হল United Nations of Educational Scientific and Cultural Organization (UNESCO)। এই UNESCO গঠিত হয় ১৯৪৫ সালের ১৬ই নভেম্বর। UNESCO গঠনের সময় রাষ্ট্রসংঘের চার্টারে ১নং ধারায় বলা হয়েছিল যে, বিশ্বের জাতিপুঞ্জে শান্তি ও নিরাপত্তা কায়েম রাখার জন্য সংশ্লিষ্ট দেশগুলি শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির উন্নয়ন ঘটিয়ে জাতি, ধর্ম, ভাষা, লিঙ্গ নির্বিশেষে সারা পৃথিবীর মানুষের উন্নয়ন ঘটাতে হবে। এই দৃষ্টিভঙ্গিকে সামনে রেখে UNESCO সারা পৃথিবীর মানুষের জন্য উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে আসছে। প্যারিসে অবস্থিত UNESCO-র মূল কেন্দ্রে পাঁচটি বিভাগ রয়েছে এবং এছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় ৫৬টি ফিল্ড অফিস আছে এবং দুটি UNESCO প্রতিষ্ঠান এবং একটি কেন্দ্র আছে। ১৯৭২ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক শিক্ষা কমিশন এডগার ফরের (Edgar Faure) সভাপতিত্বে একটি শিক্ষাকমিশন তার প্রতিবেদন পেশ করেন। সেই প্রতিবেদনের নাম ছিল “Learning to be” শিরোনাম। এই প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পর UNESCO একে আরও বাস্তব রুপ দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু ইতিমধ্যে সারা বিশ্বে তথ্য ও প্রযুক্তির বিস্ময়কর উন্নতি ঘটে গেছে আর বিশ্বায়নের ফলে মানুষের মধ্যে উদ্বেগ ও পীড়ন অনেক বেড়ে গেছে। তাই মানব সমাজকে নিজের অন্তরের খোঁজ যেমন করতে হবে তেমন তার চারপাশের জগতকেও মূল্যায়ন করতে হবে। এই প্রেক্ষাপটে UNESCO একবিংশ শতকের শিক্ষার জন্য আরও একটি কমিশন গঠন করেন। এর চেয়ারম্যান হলেন জ্যাকস্ ডেলর (Jacques Delor), ১৯৯৬ সালে এই কমিশনের প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এর শিরোনাম ছিল Learning: The Treasure Within (শিখন: অন্তর্নিহিত ঐশ্বর্য)। কমিশন একবিংশ শতকের শিক্ষার উদ্দেশ্যাবলী হিসাবে চারটি দিকের উপর গুরুত্ব আরোপ করে। এইগুলিকে বলা হয় শিক্ষার চারটি স্তম্ভ (Four Pillars of Education)। এই চারটি স্তম্ভ হল-
- জানার জন্য শিক্ষা (Learning to Know)
- কর্মের জন্য শিক্ষা (Learning to Do)
- একত্রে বসবাসের জন্য শিক্ষা (Learning to Live Together)
- পরিণত মানুষ হওয়ার শিক্ষা (Learning to Be)
জানার জন্য শিক্ষা (Learning to Know)
Know কথাটির অর্থ হল ‘জানা’। আমরা বলি জ্ঞান। বেঁচে থাকার জন্য প্রতি মুহূর্তে আমাদের জানার প্রয়োজন। জানার ফলে আমাদের মধ্যে একটা চিন্তা করার ক্ষমতা, বিচার করার ক্ষমতা, জীবনযাপন করার চেতনা বা উপলব্ধি গড়ে ওঠে। জ্ঞানসমৃদ্ধ হলেই মানুষ তার করনীয় কি তা সে বুঝতে পারে। কর্মদক্ষতার জন্য জ্ঞান প্রয়োজন, আবার জ্ঞানে বলীয়ান না হলে বা জ্ঞান সমৃদ্ধ না হলে মানুষের মনুষ্যত্ব বোঝা যায় না। অর্থাৎ মানুষের কর্মজগত, অনুভূতির জগত জ্ঞান সমৃদ্ধতার উপর নির্ভরশীল। হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ গীতায়, এই কথাটি স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে যে, কর্ম কীভাবে করা হবে সেটা নির্ভর করে সেই বিষয়ে ব্যাক্তির জ্ঞানের উপর। জ্ঞান ছাড়া সংগতিবিধান হয় না। শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, প্রাক্ষোভিক সমস্ত ক্ষেত্রে সঙ্গতিবিধানের জন্য জ্ঞানের প্রয়োজন।
জ্ঞান মানুষকে সত্য উপলব্ধি করতে, বাস্তব সমস্যার সম্মুখীন ও সমাধান করতে সাহায্য করে। এটা আসে অভিজ্ঞতার পুনর্গঠন ও পুনঃসৃজনের মাধ্যমে। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, আমাদের ভেতরেই পূর্ণতা বা জ্ঞানের ভাণ্ডার রয়েছে, সেটিকে বিকাশ করতে হয়। একই ভাবে রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধীজি জ্ঞানের জয়গান গেয়েছেন। জ্ঞান থেকে আসে মুক্তি, যার মধ্যে আছে জীবনের সম্পূর্ণ সার্থকতা। এই জ্ঞানের জন্য চাই শিক্ষা। জ্ঞান ছাড়া ব্যাক্তির বিকাশ ঘটে না, অভিযোজন ঘটে না, জ্ঞানেই মুক্তি, জ্ঞানেই জীবনের সার্থকতা।
কর্মের জন্য শিক্ষা (Learning to Do)
বর্তমান যুগের মানুষের জীবনযাত্রার দিকে তাকালে আমরা দেখি যে, মানুষ যন্ত্রের মত প্রতিমুহূর্তে কোন না কোন কাজ করে চলেছে। এই কাজ করা কে আমাদের শাস্ত্রে বলা হয়েছে worship। গোটা শিক্ষা প্রক্রিয়ার উদ্দেশ্য হল মানুষকে এমনভাবে গড়ে তোলা যাতে সে কাজের মানুষ হয়ে উঠতে পারে, যাতে তার মধ্যে কর্মদক্ষতার বিকাশ ঘটে। বর্তমান যুগে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অকল্পনীয় উন্নতির ফলে কাজের প্রকৃতি, পরিমাণ, ধরণ- সবকিছু দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। মানুষকে উৎপাদনশীল হতে হয়, তা না হলে জগতে তার আর কোন দাম নেই। কর্মের দিকে লক্ষ্য রেখে গোটা শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। বিবেকানন্দ, গান্ধীজি, রবীন্দ্রনাথ, রুশো প্রমুখ প্রত্যেকে শিক্ষায় ‘কাজ’-কে গুরুত্ব দিতে বলেছেন। কোঠারি কমিশনও তার রিপোর্টে কর্মশিক্ষাকে গ্রহণ করার কথা বলেছেন। ১৯৮৬ জাতীয় শিক্ষানীতিতেও শিক্ষায় ‘কাজ’-কে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। যেমন-
- ব্যাক্তি বা শিক্ষার্থীর সাথে কর্মজগতের পরিচিতি ঘটে।
- সামাজিক সমস্যাবলীর সাথে পরিচিতি ঘটানো যায়।
- সেই সমস্যাগুলোর সমধানের পথ খুঁজে পাওয়া যায়।
- গতিশীলতা ও দলগত মনোভাব সৃষ্টি হয়।
- মানবসম্পদের যথাযথ ব্যবহার হয়।
- সৃজনশীলতা, স্বাধীনতার বিকাশ ঘটে
- ব্যাক্তি অনন্দ পায় ও আজানা কে জানার অগ্রহ বাড়ে।
একত্রে বসবাসের জন্য শিক্ষা (Learning to Live Together)
মানুষ একা বাঁচতে পারে না। সেই আদিমকালে নিজের প্রয়োজনে মানুষ সমাজ ও দল গড়েছে। আজকে তার চাহিদা বেড়ে গেছে এবং এত বেড়ে গেছে যে সেই সব চাহিদা তার একার পক্ষে মেটানো সম্ভব নয়। এই চাহিদা মেটানোর জন্য তাকে অন্যের সাহায্য নিতে হয় ও অন্যকেও সাহায্য করতে হয়। এই পারস্পরিক সাহায্য ব্যাক্তিজীবনে যেমন দরকার তেমন সমাজ ও দেশ, রাষ্ট্রের জীবনেও দরকার। এই একসাথে বাঁচার জন্য সমাজ সৃষ্টি হয়েছে। জাতীয় সংহতি গড়ে উঠেছে, অন্তর্জাতিকতাবোধ গড়ে উঠেছে। রাষ্ট্রসংঘ তৈরি হয়েছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নব নব আবিষ্কারের সুফল সমগ্র মানবসমাজ সমানভাগে ভাগ করে নেবে। এক্ষেত্রে চাই পারস্পরিক সহযোগিতা ও বিনিময়। এই অগ্রগতির পাশাপাশি এসেছে মানুষের সভ্যতা ধ্বংসের উপকরণ। এক মুহূর্তে গোটা পৃথিবীর মানবসমাজ লুপ্ত হয়ে যেতে পারে। যুদ্ধ মানুষকে ধ্বংসের মুখোমুখি এনে দাঁর করিয়েছে। তাই মানবসমাজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য এই একত্রে বাস করার ধারণাটি গুরুত্ব পেয়েছে। একসাথে বেঁচে থাকার জন্য চাই উপযুক্ত শিক্ষা। শিক্ষা মানুষকে সঙ্গতিবিধানে সাহায্য করে। এই সঙ্গতিবিধান বাবা-মা, পরিবারের গণ্ডী ছাড়িয়ে ক্রমশ বিস্তৃততর হতে থাকে। একসময় তা দেশ ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে গিয়ে পৌঁছায়। আজকেও পৃথিবীর কোন মানুষ অন্যের সহযোগিতা ছাড়া বাঁচতে পারে না। তাই একসাথে বাস করার মনোভাব, ঐক্যবোধ, অভিন্নতাবোধ, ভ্রাতৃত্ববোধ, মানুষকে ভালোবাসার মনোভাব ইত্যাদি গড়ে তোলাই শিক্ষার কাজ। তাই রাষ্ট্রসংঘের এই কমিশনে Learning to Live Together বিষয়টিকে সচেতনভাবে যুক্ত করা হয়েছে। বিভিন্ন জনগোষ্ঠী প্রত্যেকেই স্বার্থপরভাবে বাঁচার চেষ্টা করেছে। এরফলে মানুষ আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে। এটাই তার ধ্বংসের কারণ হয়েছে। কারণ Learning to Live Together বা একত্রে বসবাস আজকের শিক্ষার অন্যতম বিষয় হয়ে উঠেছে।
পরিণত মানুষ হওয়ার শিক্ষা (Learning to Be)
শিক্ষার লক্ষ্য হল ‘পরিণত মানুষ’ হয়ে ওঠা। শিক্ষার দ্বারা মানুষ জ্ঞান অর্জন করে, কিন্তু এটাই সবকিছু নয়। এটা অসম্পূর্ণ থেকে যায় যদি মানুষ এই জ্ঞান ও দক্ষতাকে তার নিজের এবং তার চারপাশের মানুষের কাজে লাগাতে না পারে। মানুষের জ্ঞানার্জন করার সামর্থ্য মানুষকে মানসিক ও শারীরিক দিক থেকে সুস্থ করে তোলে। পরিবর্তিত সামাজিক পরিবেশে তাকে সঙ্গতিবিধানে সাহায্য করে। তাকে সমাজ সচেতন করে। উৎপাদনশীল করে পাশাপাশি জাতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে। আস্তে আস্তে সে শুধু তার নিজের দেশের নয়, সারা পৃথিবীর সমস্ত মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়, ভালবাসতে শেখে। অর্থাৎ এক কথায় বলতে গেলে শিশুর জ্ঞান এবং দক্ষতা লাভ তখনই অর্থবহ হবে যখন সেই জ্ঞান, দক্ষতা বৃহত্তর মানুষের কাজে লাগবে। এই মানুষ হওয়া কেবল আজকের যুগে নয়, অতীতকাল থেকে এই ধারণা চলে আসছে। বিশেষ করে আমাদের দেশে স্বামী বিবেকানন্দ, “Man Making Education”-এর কথা বলেছিলেন আর মহাত্মা গান্ধী Head, Hand বিকাশের সাথে সাথে Heart-এর বিকাশের কথা বলেছেন। আধুনিক শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষায় বাস্তবসম্মত মানুষ গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে।
সর্বোপরি, সমাজের গণতান্ত্রিক আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে তার মধ্যে মূল্যবোধ ও নৈতিকতার বিকাশ ঘটবে। নিজের স্বার্থের সঙ্গে সমাজের আর পাঁচজনের স্বার্থকে এক করে দেখতে শিখবে। এভাবে মানুষের প্রতি তার একটা মমত্ববোধ গড়ে উঠবে। শুধু দেশের মানুষের প্রতি নয়, পৃথিবীর যেখানে যত মানুষ আছে সকলের প্রতি তার মমত্ববোধ গড়ে উঠবে। এভাবে শিক্ষার্থীকে মানুষ হিসাবে গড়ে তুলতে গেলে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে শিক্ষা। একসময়ে প্রাচীনকালে মনে করা হত যে, জ্ঞানলাভ হলেই প্রকৃত মানুষ হবে তা কিন্তু ঠিক নয়। জ্ঞানার্জন, দক্ষতা অর্জনের সাথে সাথে দৃষ্টিভঙ্গী, মনোভাব, নৈতিকতা, সামাজিক গুণাবলী, ভালোমন্দের বিচার শিক্ষার্থী-মঙ্গল হবে না। এই লক্ষ্যেই শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠবে।
আধুনিক শিক্ষার উদ্দেশ্য সংকীর্ণ নয়। এই শিক্ষা জীবনব্যাপী, পরিবর্তনশীল, সমাজকেন্দ্রিক। এরই প্রেক্ষাপটে একজন মানুষকে জ্ঞানে, দক্ষতায় এবং মনোভাবে চেতনায় স্বয়ংসম্পূর্ণ করে এবং বিশ্বমানবিকতায় উদ্বুদ্ধ করে গড়ে তুলতে চাই শিক্ষা।
- বন্দ্যোপাধ্যায়, অর্চনা। শিক্ষাদর্শন ও শিক্ষানীতি। বি. বি. কুন্ডু গ্র্যান্ড সন্স, পৃষ্ঠা : ১৭২-১৮৯
- পাল, ড. অভিজিৎ কুমার। শিক্ষাদর্শনের রূপরেখা। ক্লাসিক বুকস, পৃষ্ঠা : ৬৪-৬৮
- ইসলাম, ড. নূরুল। শিক্ষাতত্ত্বের রূপরেখা। শ্রীধর প্রকাশনী, পৃষ্ঠা : ৫১-৫৫
___________________________