Kd's e-pathsala Educational Sociology অতিমারি বা মহামারির প্রতিচ্ছায়া: লকডাউনের প্রভাব (কোভিড-১৯) ভারতে গার্হস্থ্য হিংসা চিত্র

অতিমারি বা মহামারির প্রতিচ্ছায়া: লকডাউনের প্রভাব (কোভিড-১৯) ভারতে গার্হস্থ্য হিংসা চিত্র



অতিমারি বা মহামারীর প্রতিচ্ছায়া এখন সারাদেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। তাকে আমরা করোনা ভাইরাস বা কোভিড-১৯ বলে নামকরণ করেছি। কারন ২০১৯ সালের শেষদিকের থেকে চীনে এই ভাইরাসের সংক্রমণ প্রথম দেখা যায় বলে। করোনা ভাইরাস-এর উৎস সম্পর্কে পৃথিবীজুড়ে আজও সমূহ বিতর্ক বিদ্যমান। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন এই ভাইরাস-এর উৎস হল বাদুড় এবং সেখান থেকে মানুষে মানুষে ছড়িয়ে পড়ে এক বিশ্ব মহামারির আকার ধারন করে। 

 

বিশ্বজুড়ে করোনা ভাইরাসের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব সুদূরপ্রসারী। প্রত্যক্ষ প্রভাবরূপে আমরা প্রতিদিন দেখতে পাচ্ছি আমাদের চোখের সামনে লাখ লাখ মানুষ কোভিড-১৯ আক্রান্ত হচ্ছেন। ঘন বসতি অঞ্চলে আক্রান্তের হার সবথেকে বেশি। 

 

এই আক্রান্ত মানুষদের মধ্যে হাজার হাজার মানুষ তাদের প্রাণ বিসর্জন দিচ্ছেন। অন্যদিকে, অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলিতে চিকিৎসা তথা পরিকাঠামোগত দুরাবস্থা ক্রমশ আরও প্রকোট হচ্ছে। এমনকি উন্নত দেশগুলিও বিপুল সংখ্যক রোগীদের পরিষেবা দানের ক্ষেত্রে যথেষ্ট ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে খবর আসছে মানুষ মারা যাচ্ছেন বিনা চিকিৎসায়। 

এদিকে, প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে নিমিত্ত লকডাউনের ফলস্বরুপ ছোট মাঝারি বিভিন্ন ধরনের শিল্প অস্তিত্ব সঙ্কটের মুখে পড়েছে। বৃহৎ শিল্পগুলিও মূলধনের অভাবে ধুঁকতে শুরু করেছে। এগুলির সাথে যুক্ত অসংখ্য মানুষের জীবিকাও পড়েছে প্রশ্নের মুখে। পৃথিবী জুড়ে মানুষ অভাবে ধুঁকতে শুরু করেছে। পৃথিবী জুড়ে বেকারত্ব অস্বাভাবিক রকমের বেড়ে যাচ্ছে। বিশ্ব অর্থনীতি পড়েছে সঙ্কটের মুখে। স্বাভাবিকভাবে মানুষের বুকে থাবা বসাচ্ছে দারিদ্র্য, অনাহার, খাদ্যাভাব। 

সমাজের বৈষম্যমূলক চিত্রটা দিন দিন আরও বেশি প্রকোট হচ্ছে। এরই পাশাপাশি অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গিয়েছে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় সামগ্রীর কালোবাজারী। মাস্ক ও স্যানিটাইজারের মত প্রতিরোধমূলক উপকরণগুলো ছাড়াও অতি প্রয়োজনীয় টেস্টিং কিটের ক্ষেত্রেও শুরু হয়েছে দুর্নীতি।

 

অনির্দিষ্ট কালব্যাপী লকডাউনের কারণে নিত্য প্রয়োজনীয় দৈনন্দিন সামগ্রী না পাওয়ার আশঙ্কায় মানুষের মধ্যে বাড়িতে পণ্য মজুত করে রাখার প্রবণতা অত্যন্ত বেড়ে গিয়েছে। সরাসরি যার সুযোগ নিয়েছে কালোবাজারী মজুতদারেরা। ফলতই নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ার ঘটনাও চোখে পড়েছে। 

 

পরিবারের কোন সদস্যরা করোনা হওয়ার জন্য যদি বাড়ি থেকে বহিষ্কৃত করে দেওয়া হয়, পরিশেষে কোন গাছের তোলায় তাকে আশ্রয় নিতে হয় তা কি অমানবিকতার চরম দৃষ্টান্ত নয়?

যতদিন নারীরা নির্ভয়ে এবং স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারবে না, যতদিন নারীদের নিরাপত্তা এবং সহিংসতা নিয়ে আতঙ্কে থাকতে হবে, ততদিন বিশ্ব নারীদের সমানাধিকারের ব্যাপারে অহঙ্কার করতে পারবে না। 

 

২৫ শে নভেম্বর ‘অন্তর্জাতিক নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা অবসান দিবস’। এ উপলক্ষে চলতি সপ্তাহে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এই কথাগুলো বলেন। জাতিসংঘ মহাসচিবের তত্ত্বাবধানে দিবসটি উপলক্ষে ১৬ দিনব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচি আয়োজন করা হয়েছে। 

 

নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা বন্ধে গঠিত জাতিসংঘ ট্রাস্ট তহবিল বিভিন্ন সংস্থাকে তাদের উদ্যোগ ও কর্মকাণ্ডের জন্য প্রতিবছর পুরস্কৃত করে থাকে। গত দু’ই দশক ধরে এই ট্রাস্ট ১৩৯ টি অঞ্চলে ৪৬০ টি প্রকল্পে সহায়তা দিয়েছে এবং গত বছর ৬০ লক্ষ মানুষকে সাহায্য করেছে। 

 

এই উদ্যোগ সত্ত্বেও লাখো-কোটি নারী প্রতিবছর সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের প্রেসিডেন্ট মারিয়া ফানান্দো এসপিনোসা যে পরিসংখ্যান তুলে ধরেছে, তা রীতিমত আতঙ্ক জনক। তিনি জানান, বিশ্বের ৩৫ ভাগ নারী কোন না কোনভাবে শারীরিক ও যৌন হয়রানির শিকার এবং ৩৮% নারীর মৃত্যু হয় স্বামী বা সঙ্গীর নির্যাতনে। 

 

কোন পরিবারে বাবা-মা তাদের ‘করোনা’ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন জেনে, তাদের সন্তান-পুত্রবধূ, নাতি-নাতনিরা, বাবা-মাকে না জানিয়ে, তাদেরকে অসহায় অবস্থায় ফেলে রেখে তা কি নিদারুণ গার্হস্থ্য হিংসা নয়? 

আবার পরিবারের মধ্যে কেউ ‘করোনা’ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হওয়ায় তাকে দাহ না করে দূরে কোন জঙ্গলে আবর্জনার মত করে ফেলে রেখে আসে, তাকে তো গার্হস্থ্য হিংসাই বলবো। 

 

এই সব দেখে কেন জানি না আমার মধ্যে এমন এক ধরনের ভাবনার সঞ্চার হয়েছে যে, মানুষের বোধ হয় এটাই সহজাত প্রবৃত্তি যে প্রত্যেকে কেবল নিজের কথাই ভাবে, মানুষের মধ্যে পাশবিকতা, হিংসাই হল আসলে প্রধানতম প্রবৃত্তি। এছাড়া কোন ইতিবাচক ভাবনায় নিজের মনকে বেঁধে রাখতে পারছি না। এক চরম অসহয়তা যেন আমাকে গ্রাস করে ফেলছে। 

 

‘ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়ন মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, আসুন এ অপরাধের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই’- এটাই এবারের আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষের স্লোগান। ১৯৯৩ সালে ভিয়েনা মানবাধিকার সম্মেলনে তৎকালীন বিশ্ব পেয়েছিল দু’টি প্রত্যয়, নারীর অধিকার মানবাধিকার এবং নারী নির্যাতন মানবাধিকার লঙ্ঘন। আবার ১৯৯৩ সালের সেই প্রত্যয়ের অনুসরণে ২০১৯ সালে এসেও বলতে হচ্ছে নারী নির্যাতন মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। লিঙ্গভিত্তিক এই নির্যাতন নারী-পুরুষের বৈষম্যের একটি বর্বর প্রকাশ। পুরুষতান্ত্রিক সংস্কৃতি, মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গি এই সহিংসতার অন্যতম প্রধান কারণ। দুর্ভাগ্যজনক হলেও একথা সত্যি, ভারতবর্ষে নারী নির্যাতনের ভয়াবহতা ও নিষ্ঠুরতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। নির্যাতনের বৃদ্ধিতেও যুক্ত হচ্ছে নৃশংসতার মাত্রা। 

১৯৯৩ সালে ২০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের নারী নির্যাতন বিষয়ক ঘোষণায় বলা হয়, নারীর অধিকারগুলো হবে- জীবনের অধিকার, সব ধরনের বৈষম্য থেকে মুক্ত হওয়ার অধিকার, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সেবা লাভের অধিকার, কোন প্রকার নির্যাতন অথবা অমানবিক নিষ্ঠুর আচরণ অথবা অধঃস্তন দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন আচরণ ও শাস্তি না পাওয়ার অধিকার। নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে সামাজিক, অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল ধারায় নারীকে যুক্ত করার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন নারীর সবধরনের সহিংসতা ও নির্যাতন থেকে মুক্ত হওয়া।

 

ভারতবর্ষে নারী নির্যাতনের চিত্রের পাশাপাশি নারীর অগ্রগতি ও অর্জনের পরিচয়ও রয়েছে। সব ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর সক্রিয়তা, রাজনীতিতে ক্রমবর্ধমান অংশগ্রহণ, নারীর শিক্ষার হার বৃদ্ধি, আগের তুলনায় নারীর সচেতনতা ও গতিশীলতা বৃদ্ধি ইত্যাদি এখন দৃশ্যগোচর। নারীর অগ্রগতির লক্ষ্যে প্রণীত ও গৃহীত হয়েছে নানা ধরনের নীতি, কর্মপরিকল্পনা, বিধান এবং সংবেদনশীল আইন। কিন্তু এসব অর্জন ও প্রাপ্তিকে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন করে তুলছে নারীর প্রতি ক্রমবর্ধমান সহিংসতা ও নির্যাতন। সেহেতু আমাদের একজোট হয়ে এই সমস্যার প্রতি রুখে দাঁড়াতে হবে এবং গড়ে তুলতে হবে সুন্দর, বৈষম্যহীন সমাজ। 

_________________________________

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *