নির্দেশনার ধারণার বিগত কয়েক দশকে অভাবনীয় পরিবর্তন ঘটেছে। বর্তমানে নির্দেশনা শিক্ষাক্ষেত্র ছাড়াও রাজনীতি, ক্রীড়া এবং আরও অনেক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নির্দেশনার সামাজিক গুরুত্ব অনুসারে এর ব্যবহার দ্রুত হারে হয়ে চলেছে। সেহেতু আমরা আজ নির্দেশনার সংজ্ঞা, বৈশিষ্ট্য, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা করবো।
নির্দেশনার সংজ্ঞা :-
এই কথাটি ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে, যেমন- ‘নির্দেশ করা’, ‘পরিচালনা করা’, ‘সাহায্য করা ইত্যাদি। সাধারণ অর্থে ব্যাক্তিগত সাহায্যদানের যে প্রক্রিয়া তাকে নির্দেশনা বলা হয়ে থাকে। কোন ব্যাক্তি তার কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জনের জন্য যখন কোন অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ব্যাক্তির নিকট হতে সাহায্য গ্রহণ করে থাকে, তা হল নির্দেশনা। নির্দেশনা ব্যাক্তির জীবনে নানান সমস্যা সমাধানের মধ্যেদিয়ে শিক্ষার্থীর আত্মমুখী বিকাশে সহায়তা করে থাকে।
নিম্নে নির্দেশনার ধারণা আরও স্পষ্ট হবে এর কিছু সংজ্ঞা আলোচনার মধ্যেদিয়ে।
- মনোবিদ ক্রো (Crow) বলেছেন, নিজের জীবনের বিভিন্ন কাজ সম্পাদন করতে, নিজের সিদ্ধান্ত নিজে গ্রহণ করতে এবং নিজের জীবনের দায়িত্ব নিজে পালন করতে যে কোন বয়সের ব্যক্তি অন্য অভিজ্ঞ ব্যক্তির কাছ থেকে যে সাহায্য নেয়, তাই হল নির্দেশনা।
- অধ্যাপক জোন্স (Jones)-এর মতে, নির্দেশনা হল এমন এক ধরণের সাহায্য যা কোন বিশেষজ্ঞ অন্য কোন ব্যক্তির জীবনের লক্ষ্য গঠনে, লক্ষ্যের সঙ্গে যথাযথ অভিযোজনে এবং সাহায্যপ্রার্থী ব্যক্তির লক্ষ্যপূরণে বিভিন্ন বাঁধা ও সমস্যা নিরসনে সহায়তা করা।
- মনোবিদ Ruth Strange-এর মতে, নির্দেশনা হল প্রত্যেক ব্যক্তিকে সাহায্য করার প্রক্রিয়া যার মধ্য দিয়ে ব্যাক্তিগত ও সামাজিক সুখ-সমৃদ্ধির লক্ষ্যে ব্যক্তি তার নিজস্ব প্রচেষ্টার মধ্যদিয়ে অন্তর্নিহিত সম্ভাবনার বিকাশ ঘটাতে পারে।
নির্দেশনার বৈশিষ্ট্য :-
- নির্দেশনা হল একটি প্রক্রিয়া, যা দ্বারা একজন ব্যক্তি নিজ সম্বন্ধে জানতে ও বুঝতে পারে এবং নিজ ক্ষমতার সঠিক ব্যবহার করতে শেখে।
- নির্দেশনা একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া, যা আমৃত্যু পর্যন্ত চলতে থাকে।
- নির্দেশনা বাধ্যতামূলক নয়, নির্দেশনা গ্রহণ ও তা মান্য করা সম্পূর্ণরুপে সাহায্য প্রার্থীর উপর নির্ভর করে।
- ব্যক্তি বৈষম্যের নীতি মেনে নির্দেশনা প্রক্রিয়া পরিচালিত হয়ে থাকে।
- নির্দেশনা সকল স্তরে সবার জন্য প্রয়োজন।
- এটি কোন আদেশ বা উপদেশ নয়, সাধারণ অর্থে এটি সাহায্যদানের প্রক্রিয়া।
- এটি প্রতিকারমূলক, এর মাধ্যমে ব্যক্তির সমস্যার সমাধান করা হয়ে থাকে।
- এটি একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যের অভিমুখে পরিচালিত হয়ে থাকে।
উপরিউক্ত সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্যগুলি বিশ্লেষণে বলা যেতে পারে, নির্দেশনা হল এমন ধরনের সাহায্যদানের প্রক্রিয়া, যার সাহায্যে শিক্ষার্থী তার লক্ষ্য স্থির করতে পারে, নিজের আগ্রহ ও ক্ষমতা অনুযায়ী বিভিন্ন পরিবেশের সাথে সঙ্গতিবিধান করে চলতে পারে, নিজের সামর্থ্য ও সম্ভাবনাকে সঠিকভাবে নিজে বুঝতে পারে, নিজের সমস্যা নিজে সমাধান করতে পারে এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা অর্জন করতে পারে।
নির্দেশনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য :-
নির্দেশনা হল ব্যক্তিগত সাহায্যদানের প্রক্রিয়া সেহেতু এর চাহিদা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে, এটি একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যের অভিমুখে পরিচালিত হয়ে থাকে, সেহেতু নির্দেশনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যগুলি হল-
- নির্দেশনা ব্যক্তিকে তার জীবনের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক গুলিকে উপলব্ধি করতে সহায়তা করে।
- নির্দেশনার প্রধানতম উদ্দেশ্য হল এমন এক উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা যেখানে ব্যক্তির সর্বাঙ্গীণ বিকাশ সাধিত হয়ে থাকে।
- নির্দেশনার অন্যতম উদ্দেশ্য হল ব্যাক্তিকে পরিবর্তনশীল পরিবেশের সাথে খাপখাইয়ে নিতে বা অভিযোজনে সহায়তা করা।
- জীবনের অনেকগুলি বিকল্প থেকে একটি বেছে নিতে সহায়তা করে থাকে।
- ব্যক্তির নিজের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তার দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা।
- দৈনন্দিন জীবনে নানা সমস্যার সামাধান মোকাবিলা করার জন্য যে দক্ষতার প্রয়োজন তা আয়ত্ত করতে সহায়তা করে।
- ব্যক্তির জীবনের নানা প্রকার হতাশা দূরীকরণে সাহায্য করা, নির্দেশনার খুবই গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য।
- জীবনের ব্যার্থতাপূর্ণ দিকগুলির সাথে মানিয়ে নিতে কিংবা সেগুলিকে গ্রহণ করার মত মানসিক প্রস্তুতি আনতে সাহায্য করে।
নির্দেশনার পরিধি :-
উৎস: আচার্য, অধ্যাপক পূর্ণেন্দু। শিক্ষাক্ষেত্রে মূল্যায়ন ও নির্দেশনা।
নির্দেশনার প্রয়োজনীয়তা :-
- একজন শিক্ষার্থীর দৈহিক, সামাজিক, নৈতিক, আধ্যাত্মিক, প্রাক্ষোভিক, মানসিক অর্থাৎ সর্বাঙ্গীণ বিকাশে নির্দেশনা সহায়তা করে থাকে।
- যেকোনো পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে বা অভিযোজনেও নির্দেশনা সহায়তা করে থাকে। যে সকল শিক্ষার্থীরা নতুন বিদ্যালয় জীবনে প্রবেশ করছে কিংবা এক বিদ্যালয় থেকে অন্য বিদ্যালয়ে এসেছে সেক্ষেত্রেও নতুন বিদ্যালয় পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে সহায়তা করে থাকে।
- মানসিক চাপ শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যকে বিঘ্নিত করে থাকে, নির্দেশনা শিশুর মানসিক চাপ কমাতে যথোপযুক্ত সহায়তা করে থাকে।
- একজন শিশুর জন্য সঠিক শিক্ষা ও উপযুক্ত বৃত্তি নির্বাচনের ক্ষেত্রেও নির্দেশনা ভীষণরুপে প্রয়োজনীয়।
- শিক্ষার্থীর বৃত্তিমূলক ক্ষেত্রে বিকাশ সাধনে সহায়তা করে।
- শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের মধ্যেকার অসামঞ্জস্যতা দূর করে, যথাযত ভাবে মানবশক্তির বিকাশে সহায়তা করে থাকে।
- শ্রেণীকক্ষের পিছিয়ে থাকা ছাত্রছাত্রীদের স্বাভাবিক জনস্রোতে নিয়ে আসতে সহায়তা করে।
- শিক্ষাক্ষেত্রের অপচয় ও অনুন্নয়ন রোধ করতে সহায়তা করে থাকে।
- শিক্ষার্থীর মধ্যকার দ্বন্দ্ব ও প্রাক্ষোভিক সমস্যার সমাধানে সহায়তা করে।
সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি-
- আচার্য, অধ্যাপক পূর্ণেন্দু। শিক্ষাক্ষেত্রে মূল্যায়ন ও নির্দেশনা। শ্রীতারা প্রকাশনী, পৃষ্ঠা : ১-১৩
- ঘোষ, ড. সনৎ কুমার। শিক্ষায় সঙ্গতি-অপসঙ্গতি এবং নির্দেশনা। ক্লাসিক বুকস্, পৃষ্ঠা : ১৮১ – ১৯৮
- মণ্ডল, ভীম চন্দ্র। শিক্ষায় নির্দেশনা ও পরামর্শের রূপরেখা। সোমা বুক এজেন্সী, পৃষ্ঠা : ১৭ – ৪৮
_____________________________