শিক্ষাগত ব্যবস্থাপনার (Educational Management) ক্ষেত্রেও পরিকল্পনা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। শিক্ষাগত পরিকল্পনা সিদ্ধান্ত গ্রহণকে সাফল্যমণ্ডিত করতে সাহায্য করে। শিক্ষার গুণগত ও পরিমাণগত মানকে উন্নত করার পশ্চাতে তাই শিক্ষাগত পরিকল্পনার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। প্রয়োজনীয় উদ্দেশ্য সাধনের জন্য শিক্ষাব্যবস্থায় মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের প্রচেষ্টাই হল শিক্ষাগত পরিকল্পনা বা শিক্ষা পরিকল্পনা।
পূর্বপরিকল্পনা ছাড়া যেকোনো কাজ করা সম্ভব নয়, সে তা শিক্ষা বিষয়ক কর্মসূচি কিংবা কার্যক্রম হোক। পূর্বপরিকল্পনা ছাড়া যেকোনো কাজে সফলতার সম্ভাবনা কমে যায়। তাই যেকোনো কাজ শুরু করার আগে কাজের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে ধারাবাহিকভাবে চিন্তা করে বাস্তবায়নের দিকে যাওয়াকে পরিকল্পনা বলা হয়।
Koontz and O’Donnell এর মতে, পরিকল্পনা এমন একটি উন্নত বুদ্ধি সম্পন্ন প্রক্রিয়া যাতে বিচক্ষণতার সাথে কর্মপদ্ধতি স্থির করা এবং উদ্দেশ্য, ঘটনা এবং বিচার-বিবেচনা ভিত্তিক হিসাবের উপর নির্ভর করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়ে থাকে।
Coombs এর মতে, শিক্ষার্থী ও সমাজের চাহিদা ও উদ্দেশ্য নিরিখে শিক্ষাকে আরও ফলপ্রসূ করার জন্য যুক্তিপূর্ণ, নিয়ম আবদ্ধ বিশ্লেষণ পদ্ধতি প্রয়োগ করাকেই শিক্ষা পরিকল্পনা বলে।
বর্তমানে শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষাগত পরিকল্পনা বাধ্যতামূলক হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন ধরনের সমস্যা যথা- জনসংখ্যার বৃদ্ধি, মানবসম্পদের প্রয়োজনীয়তা, বাস্তুসংস্থান, প্রাকৃতিক সম্পদের আপ্রতুলতা, বৈজ্ঞানিক উন্নতির অপরিকল্পিত ব্যবহার প্রভৃতি সমাধানের জন্য শিক্ষাগত পরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। আর শিক্ষাগত পরিকল্পনাই পারে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে সাফল্যমণ্ডিত করতে।
শিক্ষাগত পরিকল্পনার বৈশিষ্ট্য
শিক্ষাগত পরিকল্পনার প্রধান তিনটি বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। যথা-
- কর্মদক্ষতা (Efficiency)
- জটিলতা (Complexity)
- সৃজনশীলতা (Creativity)
- কর্মদক্ষতা (Efficiency) : এটি পরিমাপ করা হয় ছাত্র প্রতি শিক্ষার ব্যয়, ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত, বিদ্যালয় রক্ষণাবেক্ষণ, স্বাক্ষরতার শতকরা হিসাব, পরীক্ষায় সফল ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যার দ্বারা।
- জটিলতা (Complexity) : নির্দিষ্ট সময় ধরে নীতি বাস্তবায়িত করতে হয় আথবা দুই বৎসরেই এর কোন পরিবর্তন করা যায় না।
- সৃজনশীলতা (Creativity) : মৌলিকত্বের দিক থেকে নীতি নান্দনিক ও সামান্য অর্থে বিজ্ঞানভিত্তিক। বিবিধ শিক্ষার বিষয়কে একসূত্রে গ্রথিত করে ইপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়।
শিক্ষাগত পরিকল্পনার ধাপ
শিক্ষার যেকোনো ক্ষেত্রেই পরিকল্পনা রচনাকালে বেশ কয়েকটি ধাপ অনুসরণ করা হয়ে থাকে, যেগুলি সমাজের সাংগঠনিক কাঠামো ও আর্থ-সামাজিক প্রয়োজনের সাথে সংগতি রেখে গড়ে ওঠে। এই ধাপগুলিকে নিম্নে চিত্রের মাধ্যমে তুলে ধরা হল।
শিক্ষাগত পরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তা
- শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাফল্য নির্ভর করে সুষ্ঠু শিক্ষা পরিকল্পনার রুপায়নে।
- যেকোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সার্বিক লক্ষ্য পূরণে এবং সকল সম্ভাবনাগুলির বাস্তব রুপদানের জন্য শিক্ষা পরিকল্পনা আপরিহার্য্য।
- সুনির্দিষ্ট এবং সুসামঞ্জস্যপূর্ণ পরিকল্পনা সময় ও শ্রমের সাশ্রয় করে।
- যেকোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মানব সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারকে সুনিশ্চিত করে।
- কার্যকরী উৎসগুলির যথাযথ সন্ধান ও বাস্তবক্ষেত্রে প্রয়োগে সহায়তা করে।
- শিক্ষাকে পরিবর্তনশীল সমাজের সাথে দ্রুত পরিবর্তনে সহায়তা করে থাকে।
- শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উন্নতির জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য পরিকল্পনা প্রয়োজন।
- শিক্ষা সংস্থার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা অক্ষুন্ন রাখতে পরিকল্পনা খুবই প্রয়োজনীয়।
শিক্ষাগত পরিকল্পনার শ্রেণীবিভাগ
শিক্ষাগত পরিকল্পনার হল কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উন্নতিকল্পে গৃহীত কোন সিদ্ধান্ত বা যৌক্তিক প্রক্রিয়া যা ভবিষ্যতে নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জনের জন্য গৃহীত। শিক্ষাগত পরিকল্পনার বেশ কিছু শ্রেণীবিভাগ বর্তমান, যা নিম্নে উল্লেখ করা হল।
- কৌশলগত পরিকল্পনা : এই স্তরের পরিকল্পনা হল একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা। এটি একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সার্বিক উন্নতিকল্পে গৃহীত হয়ে থাকে। এই প্রকারে পরিকল্পনা ১০ থেকে ১২ বছরের জন্য গৃহীত হয়ে থাকে।
- ক্ষুদ্র পরিসরের পরিকল্পনা : এই পরিকল্পনা তিন থেকে পাঁচ বছরের জন্য রচনা করা হয়। খুব অল্পসময়ের ব্যবধানে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য ক্ষুদ্র পরিসরের পরিকল্পনা গৃহীত হয়ে থাকে। যেমন- শিক্ষাক্ষেত্রে Minor Research Project গুলি ক্ষুদ্র পরিসরের পরিকল্পনার অন্তর্গত।
- সাংগঠনিক পরিকল্পনা : যেকোনো সংগঠনের উন্নতিকল্পে যে ধরনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়ে থাকে, তাই হল সাংগঠনিক পরিকল্পনা। এটি দীর্ঘ বা স্বল্প দুই ধরণের হতে পারে। এর লক্ষ্য হল পরিকল্পিত পরিকল্পনাকে বাস্তবায়নের জন্য গৃহীত সিদ্ধান্ত।
- তৃনমূল স্তরের পরিকল্পনা : পরিকল্পনা যেকোনো স্তরেই গৃহীত হয়ে থাকে, কিন্তু যেসকল পরিকল্পনা একেবারে ব্লক স্তরে রচিত হয়ে থাকে, তাই হল তৃনমূল স্তরের পরিকল্পনা।
- এলাকা ভিত্তিক পরিকল্পনা : ভারতবর্ষে এলাকাভিত্তিক বা অঞ্চলভিত্তিক পরিকল্পনা ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা থেকে শুরু হয়। এই পরিকল্পনার ক্ষেত্রে ব্লক ও আঞ্চলিক স্তরের পরিকল্পনাকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়। রাজ্যস্তরের পরিকল্পনাকে গুরুত্ব দিয়েই অঞ্চলভিত্তিক পরিকল্পনা তৈরি করা হয়। যেমন- কোন অঞ্চলে বিদ্যালয় বা কলেজ তৈরি করতে হলে তার পরিচালনা সমিতিতে কারা থাকবেন, অর্থ কোথা থেকে আসবে, বিদ্যালয় বা কলেজটি কি ধরণের হবে ইত্যাদি।
- প্রতিষ্ঠানগত পরিকল্পনা : প্রতিষ্ঠানগত চাহিদা, উন্নতি সম্পাদনের প্রয়োজনে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন ধরণের পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারে। এই পরিকল্পনা স্বল্প পরিসর বা দীর্ঘ পরিসর যেকোনো ধরণের হতে পারে।
শিক্ষাগত পরিকল্পনার দৃষ্টিভঙ্গি
শিক্ষাগত পরিকল্পনার তিনটি দৃষ্টিভঙ্গি আছে। যথা-
- ম্যাক্রো স্তরের পরিকল্পনা : এই পরিকল্পনার ক্ষেত্রে জনস্বার্থের উপর অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। শিক্ষাক্ষেত্রে এই ধরণের পরিকল্পনা গুলি হল- কোন পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় কতকগুলি স্কুল-কলেজ খোলা দরকার, কতজন শিক্ষকের নিয়োগ প্রয়োজন, এই সমস্ত খরচের উৎস কি হবে ইত্যাদি।
- মাইক্রো স্তরের পরিকল্পনা : এই পরিকল্পনার ক্ষেত্র ব্যক্তিকেন্দ্রিক। যেমন- একজন ব্যক্তি তার শিক্ষাগত যোগ্যতার চরমস্তরে পৌছাতে চাইলে তারজন্য যে পরিকল্পনা তৈরি করা যাবে তাকে, মাইক্রো স্তরের পরিকল্পনা বলা যেতে পারে।
- তৃনমূল স্তরের পরিকল্পনা : এই পরিকল্পনায় ছোট জনগোষ্ঠীর উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। যেমন- কোন একটি ব্লকে নতুন কোন স্কুল, কলেজ স্থাপন করতে হবে কি না, স্থাপিত হলে তার অর্থের জোগান কথা থেকে আসবে, স্কুল বা কলেজের প্রকৃতি কি ধরণের হবে, কতজন শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে ইত্যাদি।
সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি
- চক্রবর্তী, ড. দিলীপ কুমার। শিক্ষাগত ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনা। কে. চক্রবর্তী পাবলিকেশনস্, পৃষ্ঠা : ১১৭-১৩৮
- তরফদার, ড. মঞ্জুষা। শিক্ষাশ্রয়ী সমাজবিজ্ঞান। কে. চক্রবর্তী পাবলিকেশনস্, পৃষ্ঠা : ২৫৫-২৮১
___________________________