Kd's e-pathsala Educational Sociology সমাজতত্ত্বে ব্যবহৃত বিভিন্ন পদ্ধতি সমূহ- বৈজ্ঞানিক, ঐতিহাসিক, দার্শনিক ও তুলনামূলক পদ্ধতি

সমাজতত্ত্বে ব্যবহৃত বিভিন্ন পদ্ধতি সমূহ- বৈজ্ঞানিক, ঐতিহাসিক, দার্শনিক ও তুলনামূলক পদ্ধতি



সমাজতত্ত্বের গতিশীল চরিত্র অনুধাবন করতে হলে প্রয়োজন উপযোগী আলোচনা পদ্ধতি। এর সাহায্যে সমাজতত্ত্বের ঘটনা ও বিষয়াদির যথাযথ ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করা সম্ভব এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার জন্য অর্থবহ আলোচনা পদ্ধতির অপরিহার্য্যতা ও অনস্বীকার্য্য। 

এই আলোচনা পদ্ধতির অর্থ সম্পর্কে প্রথমে অবহিত হওয়া আবশ্যক। প্রকৃত প্রস্তাবে সুশৃঙ্খল প্রণালীতে আলোচনাকেই অনুসন্ধান পদ্ধতি (Methodology) বলা হয়। আলোচনা পদ্ধতির ইংরাজী প্রতিশব্দ হল ‘Method’। এই Method শব্দটির সৃষ্টি হয়েছে দুটি গ্রীক শব্দের সমাহারে, এই দুটি গ্রীক শব্দ হল- Meta এবং Hodos– এর অর্থ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অধ্যাপক জিসবার্ট তাঁর,Sociology” শীর্ষক বইতে বলেছে,- it means an opt way of doing something, as investigation or teaching, with brevity, through mess and merits the results to be attained’.

 

সামাজিক বিজ্ঞান সমূহের পরিবারে সমাজতত্ত্ব হল একটি নবীন সদস্য, তবে অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞান অনুসৃত পদ্ধতির মাধ্যমে সমাজতত্ত্ব সামাজিক বিষয়াদির ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ এবং নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। সমাজ ও সামাজিক উপাদান সমূহ বিশেষভাবে জটিল পদ্ধতির এই সমস্ত সামাজিক বিষয় সম্পর্কে অনুধাবন ও অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে এককভাবে কোন পদ্ধতি যথেষ্ট প্রতিপন্ন হয় না। 

 

এই উদ্দেশ্যে তত্ত্বের আলোচনা পদ্ধতিকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথা-

  1. পরীক্ষামূলক বা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি
  2. ঐতিহাসিক পদ্ধতি
  3. দার্শনিক পদ্ধতি
  4. তুলনামূলক পদ্ধতি

 

১. পরীক্ষামূলক বা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি : বিষয়বস্তু বিচার, বিশ্লেষণ ও অনুধাবনের উদ্দেশ্যে সকল বিজ্ঞানী বৈজ্ঞানিক বা পরীক্ষামূলক পদ্ধতি অবলম্বন করে থাকে। এই পদ্ধতির উল্লেখযোগ্য বিষয়াদি হল- বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ, শ্রেণী বিভক্তিকরণ, পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফল, বিচার, তুলনামূলক আলোচনা, বিশ্লেষণ, নথীভুক্তকরন প্রভৃতি। 

বৈজ্ঞানিক বা পরীক্ষামূলক পদ্ধতি প্রয়োগ সহকারে সমাজতত্ত্ববিদ্ দের দিক থেকে বিশেষ সতর্কতার প্রয়োজনীয়তা আছে কারণ, এই পদ্ধতির সীমাবদ্ধতার বিষয়টি উপেক্ষা করা যায় না, এর সীমাবদ্ধতা গুলি হল-

  1. সমাজতত্ত্বের আলোচনার ক্ষেত্র সমাজবদ্ধ মানুষ হওয়ায়, গবেষণাগারে সম্পাদিত পরীক্ষা-নিরীক্ষার দ্বারা সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব নয়।
  2. পরিবর্তন, পরিমার্জন এবং ব্যপকতার পটভূমিতে পর্যবেক্ষণমূলক পদ্ধতির সব সময় সত্য প্রতিপন্ন হয় না।
  3. সমাজতত্ত্বের উপাদানসমূহ সদাপরিবর্তনশীল, সচেতন এবং নিয়ন্ত্রণাধীন নয়।
স্বাধীন চেতনাযুক্ত মননশীল মানুষের আচার-আচরনের ক্ষেত্রে অভিনবত্ব ও বৈচিত্র্যের কারনে সমাজতত্ত্বে পরীক্ষামূলক পদ্ধতির পুরোপুরি প্রয়োগ সম্ভব হয় না। সাম্প্রতিককালে গাণিতিক ও পরিসংখ্যানমূলক পদ্ধতি প্রয়োগের দ্বারা সমাজতত্ত্ব বহুলাংশে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের পর্যায়ভুক্ত হওয়ার পথে উদ্যোগী হয়েছে।

 

২.  ঐতিহাসিক পদ্ধতি : আমাদের বর্তমান সমাজ জীবনের রীতিনীতির মূলে রয়েছে, অতীতের জীবন-যাপনের পদ্ধতি, প্রচলিত প্রথা ও রীতিনীতি প্রভৃতি। এই সমস্ত বিষয়ের সুচারু আলোচনার সাথে অতীতের উৎসের অনুসন্ধান আবশ্যক এই অনুসন্ধান ঐতিহাসিক পদ্ধতির মাধ্যমেই সম্ভব। এই পদ্ধতি সম্পর্কে বিদ্যাভূষণ ও সচদেব বলেছে,- “The historical method consists of a study of events, processes and of past civilization for the purpose of finding the origins or antecedents of a temporary social life and thus of understanding this nature and working”.

 

তবে ঐতিহাসিক পদ্ধতির কিছু সীমাবদ্ধতাও বর্তমান সমাজতত্ত্বের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে ঐতিহাসিক তথ্যাদির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে এমন কোন নির্দিষ্টতা নেই। ইতিহাসের অন্তর্ভুক্ত উপাদান সমূহের সাহায্যে সমাজতাত্ত্বিক সর্বক্ষেত্রের যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর পাওয়া সম্ভব হয় না, তাই এই পদ্ধতি অবলম্বন করার ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা নেওয়া প্রয়োজন। তবে এই পদ্ধতি সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কাঠামোর বর্ণনামূলক আলোচনার ক্ষেত্রে বিশেষ উপযোগী। 

 

৩.  দার্শনিক পদ্ধতি : আধুনিক সমাজতত্ত্বের পথিকৃৎ হিসাবে পরিচিত অগাস্ট কোঁত, হাবার্ট স্পেনসার প্রমুখ চিন্তাবিদরা সমাজতত্ত্বের আলোচনায় দার্শনিক পদ্ধতির প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। এই পদ্ধতিতে একটি বিমূর্ত মৌল ধারণা থেকে শুরু করা হয় এবং এই ধারণার ভিত্তিতেই ব্যাক্তি এবং সমাজের মধ্যে সম্পর্কে প্রসঙ্গে আলোচনা করা হয়। দার্শনিক পদ্ধতি অনুসারে কতকগুলি বিষয়কে অনুমানের ভিত্তিতে স্বতঃসিদ্ধ বলে ধরে নেওয়া হয়, এবং অবরোহণ পদ্ধতিতে কতগুলি সাধারণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। দার্শনিক পদ্ধতিতে ঔচিত্য-অনুচিত্যের প্রশ্নতে গুরুত্ব দেওয়া হয়। দার্শনিক পদ্ধতিতে ভাব ও আদর্শের উপর অতিমাত্রায় গুরুত্ব দেওয়া হয় এবং বাস্তব সমাজ ও সমাজিত প্রতিষ্ঠানের ঐতিহাসিক বিবর্তনকে উপেক্ষা করা হয়। এই কারণে এই পদ্ধতিতে প্রাপ্ত ফলাফল অনেক ক্ষেত্রেই অবাস্তব প্রতিপন্ন হয়। দার্শনিক পদ্ধতিতে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মর্যাদাও দেওয়া হয় না। এই ত্রুটি গুলি থাকা সত্ত্বেয় অবরোহণ পদ্ধতির গুরুত্ব ও নৈতিক আলোচনার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না বলে দার্শনিক পদ্ধতির গুরুত্ব অপরিসীম। 

 

 ৪.  তুলনামূলক পদ্ধতি : অতীতের বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও ঘটনাবলীর সঙ্গে বর্তমানে সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহ ও ঘটনা প্রবাহকে বিশ্লেষণ করা হয় এবং তুলনামূলক আলোচনার ভিত্তিতে কার্যকারণ সূত্র নির্ধারণ কর হয়। এই প্রক্রিয়া সম্পর্কে অধ্যাপক বিদ্যাভূষণ ও সচদেব বলেছেন,- “A sociologist can purely experiment in the laboratory of the world by employing the comparative”. তুলনামূলক পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা আছে আপাত বিচারে এই পদ্ধতি যতটা সহজ বলে মনে হয় ততটা নয়। তাই এর প্রয়োগের ক্ষেত্রেও বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করার প্রয়োজনীয়তা থাকে কারণ, এই পদ্ধতিতে যে সামাজিক বিষয়সমূহের মধ্যে তুলনা করা হবে তাদের মধ্যে সামঞ্জস্য না থাকলে উপনীত সিদ্ধান্ত ভ্রান্ত বলে প্রতিপন্ন হবে। তুলনামূলক আলোচনার জন্য প্রয়োজন নির্ভরযোগ্য তথ্যাদি এবং সেই তথ্যাদিকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা।

 

উপরি আলোচিত চারটি পদ্ধতি ছাড়াও আরও কতকগুলি পদ্ধতি রয়েছে। যথা-

  1. পরিসংখ্যানমূলক পদ্ধতি
  2. অভিজ্ঞতামূলক পদ্ধতি
  3. সামাজিক নিরীক্ষণ পদ্ধতি
  4. আদর্শ নমুনা পদ্ধতি
  5. সমাজমিতি পদ্ধতি

 

উপরি আলোচিত সকল প্রকার পদ্ধতি সমাজে অবস্থিত ব্যক্তিবর্গের মধ্যেকার পারস্পরিক সম্পর্ক, বোঝাপড়া, আবেগ-অনুভুতি, এবং পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়াকে বিভিন্ন পরিমাপ পদ্ধতি প্রয়োগ করে একটি সূচক দ্বারা নির্ণয় করা চেষ্টা করে, এবং এই প্রকার সূচক দ্বারা বহুল ক্ষেত্রে সমাজস্থ ব্যাক্তির পারস্পরিক সম্পর্ক, বোঝাপড়া, আবেগ-অনুভুতি, এবং পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া প্রকাশ পায়। 

 ________________________