Kd's e-pathsala Guidance and Counselling পরামর্শদানের ধারণা, সংজ্ঞা, বৈশিষ্ট্য, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং প্রয়োজনীয়তা

পরামর্শদানের ধারণা, সংজ্ঞা, বৈশিষ্ট্য, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং প্রয়োজনীয়তা



পরামর্শদান হল নির্দেশনা কর্মসূচির একটি অংশ। সমাজ যতদিন আছে ততদিন পরামর্শদান কর্মসূচি থাকবে, কেননা দৈনন্দিন জীবনে মানুষ নানান উদ্দীপক দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে, অনেক ক্ষেত্রে তারা পরিবর্তনশীল পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে সক্ষম হয় না সেইরুপ পরিস্থিতিতে একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তির নিকট হতে যে সমাধান সূত্র নিয়ে থাকে, এবং তা প্রয়োগ করে ব্যক্তিরা আত্মসচেতন, আত্মনির্ভর এবং আত্মনির্দেশনায় পারদর্শী হয়ে ওঠে, সেই প্রক্রিয়াকেই বলা হয় পরামর্শদান 

 

এই “Counselling” শব্দটি ইংরেজি ‘to counsel’ থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ হল- পরামর্শ দেওয়া। পরামর্শদান মনোবিজ্ঞানের একটি ফলিত শাখা। বিভিন্ন মনোবৈজ্ঞানিক নীতি ও পদ্ধতির উপর পরামর্শদান নির্ভরশীল। আধুনিক সমাজের সাথে অভিযোজন না করতে পেরেই মানুষ নানান সমস্যার সম্মুখীন হয়, এরূপ জটিল অবস্থা থেকেই মানুষকে তুলে আনাই হল পরামর্শদানের কাজ। এক্ষেত্রে পরামর্শদাতা কোন ওষুধপত্র প্রয়োগ না করে, শুধুমাত্র কথাবার্তা কিংবা আলাপ-চারিতার মধ্যেদিয়ে সমস্যা নিরসনের চেষ্টা করে থাকেন।

 

তবে এর সম্বন্ধে সুস্পষ্ট ধারণা অয়ত্ত্ব করতে হলে, বিভিন্ন মনোবিদদের সংজ্ঞাগুলি আলোচনা করা দরকার, যা নিম্নে উল্লেখ করা হল-

Webster’s Dictionary-তে বলা হয়েছে, পরামর্শদান হল দুটি ব্যক্তির মধ্যে পারস্পরিক মত বিনিময়।
Carl Rogers এর মতে, পরামর্শদান হল একটি ধারাবাহিক প্রত্যক্ষ সংযোগ স্থাপনের প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে নির্দিষ্ট কোন ব্যক্তির মনোভাব ও আচরণের পরিবর্তন ঘটাতে সহায়তা করে।
Erikson এর মতে, পরামর্শদান হল দুজন ব্যক্তির মধ্যে এমন একটা সম্পর্ক যেখানে একজন ব্যক্তি তার ব্যক্তিগত সমস্যার সমাধানকল্পে অন্য ব্যক্তির সাহায্য প্রার্থনা করেন।
Blocher এর মতে, এক ব্যক্তি কর্তৃক অপর ব্যক্তিকে সহায়তাদানের মাধ্যমে তার নিজ সম্পর্কে সচেতন করা ও ভবিষ্যতে কার্যকরী আচরণ সম্পাদনের লক্ষ্যে মূল্যবোধকে বিকশিত করার প্রক্রিয়াই হল পরামর্শদান।

পরামর্শদান প্রক্রিয়া সম্পর্কে উপরের সংজ্ঞাগুলি বিশ্লেষণ করলে আমরা এই প্রক্রিয়ার কতকগুলি বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে অবহিত হব এবং ঐ বৈশিষ্ট্যগুলির আলোচনায় পরামর্শদান সম্পর্কে আমাদের ধারণা আরও স্পষ্ট হবে। পরামর্শদানের বৈশিষ্ট্যগুলি হল
  1. পরামর্শদান প্রক্রিয়ায় দু’জন ব্যক্তির উপস্থিতি প্রয়োজন। একজন হলেন সাহায্যপ্রার্থী বা পরামর্শ গ্রহণকারী এবং অপরজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তি যিনি পরামর্শ দেবেন।
  2. পরামর্শদাতা ও পরামর্শগ্রহীতার মধ্যকার সম্পর্ক হবে আন্তরিক ও ঘনিষ্ঠ। পরামর্শদাতার প্রতি পরামর্শগ্রহীতার থাকবে বিশ্বাস ও আস্থা।
  3. পরামর্শদাতা এই উদ্দেশ্য নিয়ে পরামর্শদান করবেন যাতে পরামর্শ গ্রহণকারী শিক্ষার্থীর নিজের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে, পছন্দ করতে পারে। উপযুক্ত দিকে চালিত হতে পারে এবং সর্বস্তরে যেমন- বিদ্যালয়, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করতে এবং পরবর্তী জীবনে চাকুরী লাভ করতে সুপরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারে।
  4. পরামর্শদান হল নির্দেশনা কর্মসূচির একটি অংশ।
  5. পরামর্শদাতা ও পরামর্শগ্রহীতার মধ্যে মুখোমুখি (face-to-face) সম্পর্ক স্থাপিত হয়।
  6. এটি ব্যক্তির সমস্যার সমাধানের সাথে সাথে সমস্যার প্রতিরোধ করে থাকে, এটি প্রতিরোধ ও চিকিৎসামূলক প্রক্রিয়া।
  7. পরামর্শদান মূলত ব্যক্তির প্রক্ষোভ ও অনুভূতির সাথে ক্রিয়াশীল।
  8. পরামর্শদানের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল যেখানে বিভিন্ন কার্যকলাপ শৃঙ্খলাযুক্তভাবে সুবিন্যস্ত থাকে।

উপরিউক্ত সংজ্ঞাগুলি বিশ্লেষণে বলা যেতে পারে, পরামর্শদান হল এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে পরামর্শদাতা ও পরামর্শগ্রহীতার মধ্যে সুসম্পর্ক স্থাপনের মধ্যেদিয়ে, পরামর্শগ্রহীতার সমস্যামূলক দিকটি চিহ্নিত করে এবং তার সমাধানকল্পে তাকে সিদ্ধান্ত গ্রহনে সহায়তা করে। 

 

 

পরামর্শদানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য 

পরামর্শদানের প্রধানতম লক্ষ্য হল শিক্ষার্থীর সর্বাঙ্গীণ বিকাশে ও পরিবর্তনশীল পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে সহায়তা করা। এই লক্ষ্য চরিতার্থ করার জন্য প্রধান যে উদ্দেশ্যগুলি গৃহীত হয়ে থাকে, তা হল-

  1. ব্যক্তির মধ্যেকার দুর্বলতা ও সমস্যাগুলিকে চিহ্নিত করা।
  2. ব্যক্তির সমস্যা সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করা।
  3. সমস্যা সমূহের পরিপ্রেক্ষিতে ফলগুলি কি হতে পারে তার নিকট ব্যাখ্যা করা।
  4. একজন ব্যক্তিকে মানসিকভাবে চাঙ্গা করে তোলা।
  5. ব্যক্তির অন্তর্দৃষ্টি জাগরণে সহায়তা করা।
  6. উপযুক্ত শিক্ষাক্রম এবং কেরিয়ার নির্বাচনে শিক্ষার্থীকে সহায়তা করা।
  7. শিক্ষার্থীর অকৃতকার্যতার বিশ্লেষণ করা এবং প্রতিকারে ব্যবস্থা করা।
  8. শিক্ষার্থীর অপসঙ্গতিমূলক আচরণগুলি সংশোধনে সহায়তা করা।
  9. পরামর্শগ্রহীতার বিশ্বাস ও আস্থা অর্জন করা।
  10. ব্যক্তির আগ্রহ, চাহিদা এবং সামর্থ্যকে প্রাধান্য দিয়ে তাকে সহায়তা করা।

 

পরামর্শদানের প্রয়োজনীয়তা

প্রাত্যাহিক জীবনের সকল স্তরেই পরামর্শদান প্রয়োজন। মানুষের জীবন-যাত্রায় যত পরিবর্তন আসছে ততই সামাজিক জীবনে জটিলতার উৎপত্তি হচ্ছে, আর ততই পরামর্শদানের প্রয়োজনীয়তা বেড়ে চলেছে। শিক্ষা, পারিবারিক, বিবাহ, স্বাস্থ্য, কর্মক্ষেত্র ইত্যাদি নানান ক্ষেত্রে আজ পরামর্শদানের প্রয়োজনীয়তা ভীষণভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। নিম্নে পরামর্শদানের প্রয়োজনীয়তাগুলি উল্লেখ করা হল-

  1. ব্যক্তির মধ্যেকার স্বাধীন চেতনা ও দায়িত্ববোধ গঠনে পরামর্শদানের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এর ফলে একজন ব্যক্তি নিজ অন্তর্নিহিত সম্ভাবনাগুলির আবিষ্কার করে এবং তার বাস্তবায়ন ঘটাতে সক্ষম হয়।
  2. এই পরামর্শদান নিছক উপদেশ দেওয়া নয়। বরং নিজের সমস্যা সম্বন্ধে পরামর্শগ্রহীতাকে চিন্তা করতে শেখায়। ফলস্বরূপ সে নিজেই নিজের সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম হয়।
  3. তাৎক্ষনিক সমস্যার সমাধান করাই পরামর্শদান প্রক্রিয়ার কাজ নয়। এই প্রক্রিয়ার প্রকৃত কাজ হল- পরামর্শ গ্রহণকারীর মধ্যে এমন পরিবর্তন ঘটানো যাতে সে নিজেই তার তাৎক্ষনিক সমস্যার সমাধানে উদ্যোগী হয়।
  4. পরামর্শদান প্রক্রিয়া ব্যক্তিকে প্রেষিত করে, যার দ্বারা তাড়িত হয়ে সে নানান নতুন নতুন কাজে নিজেকে নিয়োজিত করে থাকে, এবং মানসিকভাবে সক্ষম হয়ে ওঠে।
  5. পরামর্শদান শিশুর মধ্যেকার অপসঙ্গতিমূলক আচরণগুলি দূর করতে সহায়তা করে থাকে।
  6. পরামর্শদান প্রক্রিয়া ব্যক্তিকে আত্মসচেতন, আত্মনির্ভর এবং আত্মনির্দেশনায় পারদর্শী করে তোলে।

উপরিউক্ত সকল আলোচনা থেকে আমরা এই সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে, একজন ব্যক্তির জীবনে পরামর্শদানের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা যায় না। কারণ জীবনের প্রতিটি স্তরে কিংবা দৈনন্দিন জীবনের যেকোনো মুহূর্তে এর প্রয়োজনীয়তা অবশ্যম্ভাবী। এছাড়া বর্তমান সামাজিক ক্ষেত্র এতটাই জটিল আকার ধারণ করেছে যে, মানব জীবনের নানান ক্ষেত্রে নানান ধরনের সমস্যার উদয় হচ্ছে এবং সেখান হতে নিষ্কৃতি পাওয়ার অন্যতম পন্থা হল পরামর্শদান।

 

 গ্রন্থপঞ্জি-

  • আচার্য, অধ্যাপক পূর্ণেন্দু। শিক্ষাক্ষেত্রে মূল্যায়ন ও নির্দেশনা। শ্রীতারা প্রকাশনী, পৃষ্ঠা : ৯৬-৯৮
  • ঘোষ, ড. সনৎ কুমার। শিক্ষায় সঙ্গতি-অপসঙ্গতি এবং নির্দেশনা। ক্লাসিক বুকস্, পৃষ্ঠা : ২৯৫-৩০৩
  • মণ্ডল, ভীম চন্দ্র। শিক্ষায় নির্দেশনা ও পরামর্শের রূপরেখা। সোমা বুক এজেন্সী, পৃষ্ঠা : ২০৪-২০৮
  • ইসলাম, ড. নূরুল। শিক্ষায় মূল্যায়ন ও নির্দেশনা। শ্রীধর প্রকাশনী, পৃষ্ঠা : ২২৫-২২৮

______________________________

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *