Kd's e-pathsala Great Educator প্লেটোর শিক্ষাদর্শন ও শিক্ষাচিন্তা (Plato’s Educational Philosophy and Educational Thought)

প্লেটোর শিক্ষাদর্শন ও শিক্ষাচিন্তা (Plato’s Educational Philosophy and Educational Thought)



প্লেটো ছিলেন সক্রেটিসের সুযোগ্য শিষ্য। সক্রেটিস যার রুপকার, প্লেটো হলেন তার প্রবক্তা। সক্রেটিসের চিন্তাভাবনার বাস্তবায়ন বা পূর্ণতালাভ করেছিল প্লেটোর হাত ধরে। তিনি বলেছিলেন, গ্রিস দেশের সমাজ ব্যবস্থাকে পুনরুজ্জীবিত করতে হলে ব্যাক্তির নৈতিক মানকে উন্নত করতে হবে। তিনি নীতি শিক্ষার মধ্যেদিয়ে ব্যাক্তির ব্যক্তিত্বের উন্নতি সাধন করতে চেয়েছিলেন। এছাড়া প্লেটো ছিলেন একজন ভাববাদী দার্শনিক তিনি তাঁর শিক্ষাচিন্তায় ব্যক্তিতান্ত্রিক এবং সমাজতান্ত্রিক মতবাদের সার্থক সমন্বয় সাধন করতে চেয়েছিলেন। তাঁর মতে শিক্ষা এমন হবে, যা শিক্ষার্থীর নৈতিক মানকে উন্নত করবে এবং তার সাথে সাথে শিক্ষার্থীকে সমাজ জীবনের উপযোগী করে গড়ে তুলবে।

 

 

সংক্ষিপ্ত পরিচিতি 

ভাববাদী দার্শনিক প্লেটো খ্রীস্টপূর্ব ৪২৭ সালে এথেন্সে জন্মগ্রহন করেন। তিনি ছিলেন গ্রিসের অভিজাত সম্প্রদায়ভুক্ত। প্লেটোর পিতৃদত্ত নাম ছিল অ্যারস্টিক্লিস। তিনি ছোটবেলা থেকেই অতি মেধাবী ছিলেন। প্লেটো তাঁর পিতা মাতার আজ্ঞায় বহু পণ্ডিত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসেন। তবে তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ গুরু ছিলেন সক্রেটিস। তিনি তাঁর জীবনদর্শনের শিক্ষা পেয়েছিলেন সক্রেটিসের কাছ থেকে। তাঁরই দার্শনিক চিন্তাধারায় অনুপ্রাণীত হয়ে তাঁরই নির্ধারিত পথে অগ্রসর হয়ে গ্রিসবাসীর নৈতিক আদর্শের উন্নয়নে চেষ্টা করে গেছেন। তিনি দীর্ঘ ১২ বছর তাঁর কিছু প্রিয় শিষ্যদের নিয়ে দেশ ভ্রমন করে বেড়ান এবং জ্ঞানের সম্প্রসারণ করেন। তিনি তাঁর জীবনব্যাপী সক্রেটিসের শিক্ষাচিন্তার সম্প্রসারণ করে গেছেন। অনেকে এও বলেন যে, প্লেটো যদি না জন্মাতেন তাহলে সক্রেটিসের শিক্ষাদর্শন ও শিক্ষাচিন্তার অপমৃত্যু ঘটতো। 

 

তবে প্লেটোর সংসার জীবন সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা যায়নি। তিনি বরাবরই এদিকটা এড়িয়ে চলেছেন। তাছাড়া সক্রেটিসের মৃত্যু দণ্ডের পর থেকেই তিনি সারা বিশ্বভ্রমন করেছেন এবং জ্ঞানের সম্প্রসারণ করেছেন। প্লেটোর শিক্ষাদর্শন ও শিক্ষাচিন্তা পরিপূর্ণ প্রকাশ পেয়েছে তাঁর কিছু গ্রন্থে, যেমন- Republic, Phaedo, Dialogues, Laws ইত্যাদি। এই সকল গ্রন্থ আজও পৃথিবী বিখ্যাত হয়ে থাকবে। 

 

প্লেটোর শিক্ষাদর্শন ও শিক্ষার লক্ষ্য

প্লেটো ছিলেন একজন ভাববাদী দার্শনিক এবং তাঁর শিক্ষাচিন্তায় সক্রেটিসের প্রভাব প্রত্যক্ষভাবে পরিলক্ষিত হয়। তাঁর শিক্ষাচিন্তার মূল কথা হল- ব্যক্তি জীবনের নৈতিক মানকে বিকশিত করা, ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের বিকাশ সাধন এবং তার সাথে সাথে ব্যক্তিকে সমাজ জীবন ধারণের উপযোগী করে গড়ে তোলা। 

জীবনের সকল প্রকার শ্রেষ্ঠ আদর্শগুলিকে অনুসরণ করা এবং সেই সম্বন্ধে যথাযথ জ্ঞান আহরণ করাই হল তাঁর মতে শিক্ষার প্রকৃত লক্ষ্য। প্লেটোর মতে শিক্ষা হল, আত্মার পুনর্বিন্যাসের প্রক্রিয়া। তিনি শিক্ষা শব্দের সমার্থক শব্দ হিসাবে “Conversion” কথাটি ব্যবহার করেছেন। অর্থাৎ, তাঁর মতে শিক্ষা হল জন্মান্তরের প্রক্রিয়া। ব্যক্তির অন্তরাত্মাকে প্রকৃত আদর্শের দিকে পরিচালিত করাই হল শিক্ষার লক্ষ্য। শিক্ষা সম্পর্কে প্লেটোর মূল কথা হল- মানুষের আত্মার গতিপ্রবাহকে সৎ ও আদর্শের পথে পরিচালিত করা। 

 

 

প্লেটোর প্রস্তাবিত পাঠ্যক্রম

প্লেটোর শিক্ষাক্রম দীর্ঘ সময় ধরে মনোযোগ সহকারে পড়াশুনা করার নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। তাঁর মতে দীর্ঘ সময়ব্যাপী পড়াশোনা করা ব্যাতিত গভীর জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব নয়। প্লেটো তাঁর “Republic” গ্রন্থে শিক্ষাব্যবস্থাকে দু’ভাগে ভাগ করেছেন। যথা-

      1. প্রাথমিক শিক্ষা
      2. উচ্চ শিক্ষা 
প্লেটোর প্রস্তাবিত শিক্ষা কাঠামো, বয়সসীমা সহিত প্রস্তাবিত পাঠ্যক্রম নিম্নে একটি ছকের মাধ্যমে দেখানো হল- 

প্লেটোর পাঠ্যক্রম অনুসারে ৩৫ বৎসর পর শিক্ষার্থীরা শিক্ষানবিশ হিসাবে চাকুরি পাবেন। এর সময়সীমা হল ৫০ বৎসর। ৫০ বছর পর যারা সফল হবেন তারা Supreme Council-এ চাকুরী পাবার যোগ্য হবে। 

প্লেটোর শিক্ষণ পদ্ধতি

প্লেটো বলেছিলেন শিশুর শিক্ষা অল্পবয়সে শুরু হবে না। কিন্তু তিনি তাঁর শিক্ষাচিন্তায় শিক্ষাপদ্ধতিকে যথেষ্ট নিয়ন্ত্রিতরূপে বর্ণনা করেছিলেন। প্লেটো তাঁর শিক্ষাপদ্ধতিতে শিশুর স্বাধীনতার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। তাঁর মতে, শিক্ষাকে আকর্ষণীয় রূপে শিক্ষার্থীর সামনে পরিবেশন করতে হবে। তাঁর মতে শিশুর উপর কোন কিছু জোড় করে চাপিয়ে দেওয়া যাবে না, শিক্ষাগ্রহণের ক্ষেত্রে সে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করবে। এক্ষেত্রে শিক্ষাপদ্ধতি হিসাবে তিনি তিনটি পদ্ধতিকে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। যথা- 

      1. গল্পচ্ছলে শিক্ষা
      2. খেলাচ্ছলে শিক্ষা
      3. অনুকরণের মাধ্যমে শিক্ষা


 

প্লেটোর মতে শিক্ষালয়

প্লেটো তাঁর শিক্ষাদর্শনকে বাস্তবিক রুপদানের জন্য শিক্ষালয় প্রতিষ্ঠার চিন্তাভাবনা করেন। শিক্ষার উদ্দেশ্যকে হাসিল করার জন্য তিনি বিদ্যালয় স্থাপন করেন। যেখানে অন্তর্ভুক্ত ছিল প্রাথমিক জ্ঞানের উপযোগী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শারীরিক ও সময় বিদ্যার উপযোগী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, দার্শনিক, সাহিত্যিক, রাষ্ট্রনায়ক, গবেষক সৃষ্টির উপযোগী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। 

 

 

 

প্লেটোর মতে শিক্ষক

প্লেটো ছিলেন একজন ভাববাদী দার্শনিক সেহেতু তাঁর চিন্তাধারায় ভাববাদী দর্শনের প্রত্যক্ষ প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। শিক্ষকের ধারণার ক্ষেত্রেও তাঁর ভাববাদী দর্শনের চিন্তাভাবনার প্রতিফলন ঘটেছে। প্লেটোর মতে, শিক্ষক হবেন একজন উন্নত চরিত্র এবং অত্মপলব্ধি সম্পন্ন ব্যক্তিত্বের অধিকারী। শিক্ষার্থীরা তাঁর উন্নত ব্যক্তিত্বকে অনুকরণ করে নিজ ব্যক্তিত্ব গড়ে তুলবে। এবং এক্ষেত্রে বাস্তব জগত সম্বন্ধে যথাযথ নির্দেশনা দান করাই হবে শিক্ষকের প্রধান দায়িত্ব। 

 

  

শরীরচর্চা ও নারীশিক্ষা

প্লেটোর ধারণা ছিল ব্যক্তির নৈতিক বিকাশের সাথে সাথে শারীরিক বিকাশও একান্ত অপরিহার্য্য। তাই তিনি সাধারণ শিক্ষায় শারীরিক শিক্ষাকে অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলেছেন। অন্যদিকে প্লেটো নারীশিক্ষা তথা তাদের সৃজনী প্রশিক্ষণদানের কথাও বলেছেন, যার আধুনিক শিক্ষার উন্নয়নে বিশেষ অবদান রয়েছে। তিনি বিশ্বাস করতেন গতানুগতিক পারিবারিক জীবনে স্ত্রীজাতির সৃজনীস্পৃহার বিকাশ সম্ভব নয়। প্রকৃতপক্ষে প্লেটো নারী পুরুষ উভয়েরই শরীর ও মনের পরিপূর্ণ বিকাশ চেয়েছেন। 

 

 

প্লেটোর শিক্ষাদর্শনের উল্লেখযোগ্য দিক

প্লেটোর শিক্ষাদর্শনের উল্লেখযোগ্য দিকগুলি হল-

  1. শিক্ষা হল দীর্ঘকালব্যাপী নিরবিচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া।
  2. শিক্ষা হল জন্মান্তরের প্রক্রিয়া।
  3. শিক্ষার উদ্দেশ্য হল প্রকৃত জ্ঞানী, দার্শনিক এবং সমাজসেবক তৈরি করা।
  4. বাস্তব সামাজের সাথে যুক্ত শিক্ষাপ্রদান করা।
  5. শিক্ষার্থীর নৈতিক মানকে বিকশিত করা এবং সমাজজীবনের উপযোগী করে গড়ে তোলা।
  6. শিক্ষাক্রমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর সৃজনশীলতার দিকের বিকাশ সাধন।
  7. শিক্ষাপদ্ধতিতে গল্পের মাধ্যমে সম্পূর্ণ বিষয়ে শিক্ষাদান।
  8. এছাড়া চরম বাস্তবতার সাথে সম্পর্ক রেখে সম্পূর্ণ শিক্ষাদান। 

 

বিশিষ্ট চিন্তাবিদ জর্জ কেনেডি প্লেটোর শিক্ষাদর্শনের মূল্যায়ন প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন, “Plato’s frame in the history of education rests on his utopian plan for education and not on his work as practical teacher in the academy” অর্থাৎ প্লেটো তাঁর শিক্ষানীতির তাত্ত্বিক অবদানের জন্যই বিখ্যাত; শিক্ষানীতির ব্যহারিক উপযোগিতার জন্য নয়। তবে যত সমালোচনা থাকুক না কেন এর দার্শনিক ভিত্তি এবং সমাজের সেবা ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার যে প্রয়াস তিনি চালিয়েছেন তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার যোগ্য। তিনি খ্রিষ্টপূর্ব ৩৪৮ সালে মৃত্যুবরন করেন, কিন্তু তিনি আজও তাঁর শিক্ষা সম্পর্কীয় চিন্তাভাবনার জন্য বিশ্ব জগতে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। 

 

 

সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি 

  • রায়, সুশীল। শিক্ষাতত্ত্ব ও শিক্ষাদর্শন। সোমা বুক এজেন্সী, পৃষ্ঠা : ৬১৯-৬২২

_________________________