টোল শব্দটি কানে আসলে বর্তমানে আমাদের মনে 'টোল ট্যাক্স' এর কথা মাথায় চলে আসে। কিন্তু অতীতে উচ্চশিক্ষার প্রধানত শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল এই টোল শিক্ষাকেন্দ্রগুলি। বঙ্গভূমে টোল শব্দটির অবস্থান ছিল তৎকালীন শিক্ষাব্যবস্থার হৃদয় কোমলে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর শিক্ষা গ্রন্থের শিক্ষা সমস্যা প্রবন্ধে বলেছেন. এই টোলের ক্ষেত্রে লক্ষ্য করলেও দেখা যাইবে চতুস্পাটি কেবলমাত্র পুঁথির পড়াটাই সবচেয়ে বড় জিনিস নয়। সেখানে চারিদিকেই অধ্যাপনার হাওয়া বইতেছে। গুরু নিজেও এই পড়া লইয়াই আছেন। শুধু তাই নয়, সেখানে জীবনযাত্রা নিতান্ত সাদাসিধা, বৈষয়িকতা, বিলাসিতা মনকে টানা ছেঁড়া করিতে পারেনা, সুতরাং শিক্ষাটা একেবারে স্বভাবের সঙ্গে মিশ খাইবার সময়ও সুবিধা পায়। সংস্কৃতি চর্চা, টোল সংস্কৃতি বলতে নদীয়ার নবদ্বীপ এবং উত্তর কলকাতাকেই বোঝাত। ষোল শতকের নবদ্বীপের টোলগুলোতে বহুসংখ্যক পড়ুয়া ছিল। নবদ্বীপের টোলগুলোর গৌরব ছিল সর্বজনবিদিত। বৃন্দাবন ঠাকুর লিখেগেছেন, সতেরো শতকে নবদ্বীপের নানান স্থানে টোল গুলো খুব জোরেশোরে চালু হয়েছিল। দূরদূরান্ত থেকে ছাত্ররা এসে এখানে শিক্ষা গ্রহণ করত। আয়ুর্বেদ, কাব্য থেকে ন্যায় দর্শন সবই পড়ানো হয় সেখানে। মূলত সংস্কৃত ভাষায় শিক্ষাদানে পন্ডিত তৈরি করার কাজ করা হতো। তৎকালীন রাজপরিবার কর্তৃক এই শিক্ষার ব্যয় নির্বাহ হত। মধ্যযুগের বাংলার সংস্কৃত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো টোল নামেই পরিচিত ছিল। উত্তর ভারতে এ ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে সাধারণত চতুস্পাটি বলা হত। চতুস্পাটি কথার অর্থ হলো চারবেদ পাঠের প্রতিষ্ঠান। বাংলায় সাধারণত তিন ধরনের টোল ছিল। কিছু টোলে প্রধানত ব্যাকরণ, সেই সঙ্গে সাহিত্য, অলংকার ও কখনো পৌরাণিক কাব্য পড়ানো হতো। দ্বিতীয় ধরনের টোলে প্রধানত স্মৃতি এবং সেই সঙ্গে কখনো পৌরাণিক কাব্য পড়ানো হতো। আর তৃতীয় টোলের ন্যায় শাস্ত্রই ছিল প্রধান পাঠ্য বিষয়। সাধারণত বেশিরভাগ টোলে যে কোন একটি বিশেষ বিষয়ে উচ্চ শিক্ষা দেওয়া হত। এই প্রকার টোল গুলিতে শিক্ষাপদ্ধতি হিসাবে মৌখিক পদ্ধতি এবং এছাড়া বিতর্ককেও শিক্ষাপদ্ধতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়, এছাড়াও গ্রন্থ পাঠ করে তার সমস্ত শ্লোক কণ্ঠস্থ করে ফেলা এবং যখন দুজন শিক্ষক কোন মত নিয়ে তর্ক করেন, ছাত্র-ছাত্রীদের তা শোনার অধিকার থাকে এবং সেই বিতর্কের কোন অংশ যদি শিক্ষার্থীদের জটিল বলে মনে হয় তবে তারা শিক্ষকের কাছে তার অর্থ জিজ্ঞাসা করে বুঝে নিতে পারে। পুঁথির প্রচলন কিন্তু ছিল, অনেক শিক্ষকই পুঁথি রচনা করতেন এবং পুঁথি রচনা করাও শিক্ষাদানের মর্যাদা পেত। এই টোলগুলিতে বিশেষত ব্রাহ্মণ সন্তানদের আধিক্য লক্ষ্য করা যেত, সেই কারণেই বিশেষত ব্রাহ্মণ বসতিপূর্ন গ্রামে এই টোলগুলি গড়ে উঠত। শিক্ষা ছিল সম্পূর্ণরূপে অবৈতনিক। এখানে অর্থের পরিবর্তে শিক্ষাদানকে পাপ কাজ বলে মনে করা হতো। সাধারণত টোল গুলিতে মাসে ১০ দিন করে পাঠদানকার্য পূর্ণরূপে বন্ধ থাকতো। সাধারণতঃ টোলগুলিতে শিক্ষাদান কার্য ৮-১০ বছরের ছিল। মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য নবদ্বীপের টোল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং পরবর্তী ক্ষেত্রে অল্প বয়সে নবদ্বীপেই পাঠ শেষ করে ব্যাকরণের টোল খুলে শব্দ ও অলংকার শাস্ত্রে প্রতিভার পরিচয় দেন। তৎকালীন সময়ে বিশেষ বিষয়ে পারদর্শী ব্যক্তিরা বিশেষ উপাধিতে ভূষিত হতেন। যাঁরা ন্যায়শাস্ত্র বা স্মৃতিশাস্ত্রে অথবা উভয় বিষয়ে বিশেষজ্ঞ শিক্ষা লাভ করতেন, তাঁরা ন্যায়তীর্থ বা স্মৃতিতীর্থ অথবা উভয় উপাধি লাভ করতেন। একই বিষয়ে বিভিন্ন শিক্ষক ভিন্ন উপাধিও প্রদান করতেন। যেমন- স্মৃতিরত্ন, কাব্যরত্ন, ন্যায়রত্ন, ন্যায়বাগীশ বা তর্করত্ন প্রভৃতি। খুব কম ক্ষেত্রেই কোন ছাত্র একসাথে পাঁচটি বা সাতটি বিষয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে পারত, যারা তা করতে পারত তাদের পঞ্চতীর্থ বা সপ্ততীর্থ উপাধিতে ভূষিত করা হতো। আর যাঁরা বেদ বা বেদান্তে বিশেষ শিক্ষা লাভ করতো, তাদের বেদান্ততীর্থ উপাধি প্রদান করা হতো। তৎকালীন সময়ে বিভিন্ন রাজা-রাজরা, জমিদাররা এবং বিভিন্ন অভিজাত শ্রেণীর লোকেরা এই প্রকার শিক্ষাব্যবস্থার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। তাদের সাহায্যে তৎকালীন সময় টোল শিক্ষা জনপ্রিয়তা লাভ করে। বিভিন্ন অভিজাত শ্রেণীর দানে এই শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালিত হতো এবং তা সম্পূর্ণরূপে ছিল অবৈতনিক। বাংলার টোল শিক্ষাব্যবস্থা একসময় ভারত বিখ্যাত ছিল, এবং বহুস্থান থেকে শিক্ষার্থীরা এখানে এসে শিক্ষা গ্রহণ করতো, কিন্তু বর্তমানে এই শিক্ষা বেশ কিছু সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। অতীতে টোলের যা সংখ্যা ছিল তার অর্ধেকও বর্তমানে নেই, প্রায় সব ধুয়ে মুছে সাফ, দু-একটা যা আছে তাও আজ কোন রকমে টিকে রয়েছে। অধিকাংশ টোল গুলি শিক্ষকদের নিজ প্রচেষ্টায় কোন রকমে চলে যাচ্ছে, তা সে আর কদিন। সংস্কৃত, ব্যাকরণ শিক্ষায় শিক্ষিত পণ্ডিতরা আজ কোনক্রমে তাদের জীবন অতিবাহিত করছে। এছাড়া বর্তমান শিক্ষা এতটাই জাঁকজমকপূর্ণ যে টোল শিক্ষা তার সাথে পাল্লা দিয়ে উঠতে না পারায়,টোল শিক্ষার প্রচার ও প্রসার কমতে শুরু করেছে। বর্তমানে সরকারি সাহায্য প্রাপ্ত টোলের সংখ্যাও খুব কম, এক্ষেত্রে সরকারি হস্তক্ষেপ ছাড়া এই পরিস্থিতির উন্নতি কোনমতেই সম্ভব নয়। যার উত্থান রয়েছে তার পতনও রয়েছে। বাংলার একটি সু-প্রাচীন শিক্ষা ব্যবস্থা আজ বর্তমানের জাঁকজমককে গভীরে তলিয়ে যেতে শুরু করেছে। মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কৃত হয়েছে, রেল চালু হয়েছে, বর্তমান সমাজে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে, আধুনিক যুগ তার সুফল-এর সাথে সাথে কিছু কুফল ও কিছু ত্রুটিও বহন করে এনেছে কিন্তু কোন কিছুই বাংলার অতি প্রাচীন টোল শিক্ষাকে ধংস করতে পারেনি। বাংলার টোল গুলি আজও তার স্বাভাবিক ছন্দে শিক্ষার্থীকে জীবনে নতুন গতিপথের সন্ধান দিয়ে চলেছে।
প্রাচীন ভারতের শিক্ষাকেন্দ্র হিসাবে টোলের ভূমিকা
Categories: