Kd's e-pathsala Educational Philosophy ভাববাদী দর্শনের : ধারণা, মূলনীতি, শিক্ষায় প্রভাব, সমালোচনা এবং অবদান

ভাববাদী দর্শনের : ধারণা, মূলনীতি, শিক্ষায় প্রভাব, সমালোচনা এবং অবদান



ভাববাদ হচ্ছে সর্বাপেক্ষা প্রাচীন দার্শনিক শাখা। প্রাচীন কতকগুলো আধ্যাত্মিক নীতির উপর ভাববাদ প্রতিষ্ঠিত। আধ্যাত্মিক সত্তাগুলি প্রথম প্রকাশ পেয়েছিল পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্মের মধ্যেদিয়ে। তাই ভাববাদ ধর্মের পরিনতি হিসেবে প্রকাশ পেয়েছে বর্তমান কালে, অবশ্য ভাববাদীরা ধর্মের সঙ্গে কিছুটা সংশ্লিষ্ট থেকে নতুন এক সংজ্ঞার উপর নির্ভরশীল হয়ে নতুন পথে চলেছেন। Descartes, Berkeley, Fichte, Hegel, kant, schelling প্রভৃতি দার্শনিক ভাববাদকে নতুন পথে নিয়ে গিয়েছেন। ভাব বা আদর্শকে কেন্দ্র করে এই মতবাদ গড়ে উঠেছে বলে অনেকে একে ভাববাদ বা আদর্শবাদ বলে আক্ষা দিয়ে থাকেন। 
 
প্লেটোর অধিবিদ্যাগত মতানুসারে বলা যায় ভাববাদের ইংরেজি প্রতিশব্দ “Idealism” গড়ে উঠেছে “Idea” (ভাব) এবং “Ism” (তত্ত্ব বা বাদ) এই দুটি শব্দকে নিয়ে এবং ‘I’ অক্ষরটি মাঝে বসে অলঙ্কারের জন্য (Idealism is in reality idea-ism with the inserted for euphony)। ভাববাদের মূল বক্তব্য জ্ঞেয় বস্তু মন বা চেতনার উপর নির্ভরশীল। জাগতিক বস্তুগুলি সম্পূর্ণভাবে মন বা জ্ঞান নিরপেক্ষ কোন সত্তা নেই। ভাববাদীদের মতে চিন্তা, অনুভূতি, ইচ্ছা প্রভৃতির যেমন মন নিরপেক্ষ কোন সত্তা নেই, বাহ্যবস্তুরও কোন মন নিরপেক্ষ কোন সত্তা নেই। সুতরাং ভাববাদী দর্শনের মতে মন নিরপেক্ষ কোন বস্তুর স্বাধীন স্বতন্ত্র সত্তা নেই। 
 
 
ভাববাদী দর্শনের মূল প্রতিপাদ্য হল – 
১) প্রকৃত সত্য হল আধ্যাত্মিক সত্য।
 
২) পরমের মনে যা আছে তার বাইরে কোন সত্য নেই। মানুষের মন সেই পরম মনের অংশ তথা ছায়া মাত্র। 
 
৩) মন থেকে যা অভিক্ষেপ করা যায় তাই সত্য।
 
৪) ধারনাই অস্তিত্বের মৌল সত্য।
 
৫) পার্থিব মনকে পরম মনে বিলীন করেই ব্যক্তিত্বের পূর্ণতা লাভ করা যায়।
 
৬) জ্ঞান ও মূল্যবোধ হল অনাদি ও অনন্ত।
 
৭) সত্য, শিব ও সুন্দরকে লাভ করাই হল জীবনের চরম লক্ষ্য। 
 
৮) মানবদেহ হল মিথ্যা বা নশ্বর, আত্মাই হল প্রকৃত সত্য যা অবিনশ্বর।
 
৯) ভাব ও মূল্যবোধের জগৎ বস্তুজগৎ অপেক্ষা অধিকতর মূল্যবান। 
 
১০) নৈতিক ও কৃষ্টিগত শিক্ষা লাভই সর্বাপেক্ষা শ্রেয়। 
 
১১) সর্বশ্রেষ্ঠ মনন হল অপরোক্ষানুভূতি বা Intuition।
 

 

ভাববাদী দর্শনের বিভিন্ন রূপ / শ্রেণিবিভাগ
নিম্নলিখিত ভাবে ভাববাদের শ্রেণিবিভাগ করা হয়েছে-
 
1) Subjective idealism (Berkeley) 
2) Critical and phenomenalist idealism (Kant)   
3) Absolute idealism (Fichte’s)
4) Transcendental idealism (Schelling’s)
5) Objective idealism (Hegel’s)
6) Personal idealism or personalism

 

  
শিক্ষায় ভাববাদী দর্শনের প্রভাব
 
ভাববাদ ও শিক্ষার লক্ষ্য
ভাববাদ মানুষের আত্মউৎকর্ষণ এবং আত্মউন্মেষণের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। ভাববাদী দার্শনিকেরা মনে করেন, মানুষের ব্যক্তিত্বের সুষ্ঠু বিকাশের মাধ্যমেই আত্মপলব্ধি বা Self-realization-ই হল শিক্ষার মূল লক্ষ্য। ভাববাদী দার্শনিকরা মনে করেন, শিক্ষার মাধ্যমে যে সকল সম্ভাবনা রয়েছে তার বিকাশ ঘটবে। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, “Education is the manifestation of perfection already in man”. শিক্ষার লক্ষ্য ভাববাদী দর্শনে, সর্বজনীন যে সত্তা বা মূল্য ও নীতিবোধ তার অভিমুখী। 
 
 
ভাববাদ ও শিক্ষার পাঠক্রম
ধারণা ও আদর্শের মধ্যে থেকে পাঠক্রমের গঠনের প্রতিই ভাববাদীরা দিকনির্দেশ করেছেন। ভাববাদী দর্শন যেহেতু কতকগুলি নির্দিষ্ট চিরন্তন আদর্শের অভিমুখে শিক্ষাকে পরিচালিত করতে চায়, তাই তারা আদর্শ ও ভাবের উপর অধিক গুরুত্ত্ব দিয়েছেন। ভাববাদীরা পাঠক্রমে তিনটি কাম্যবস্তুকে গুরুত্ব দিয়েছেন – 
ক) বৌদ্ধিক (Intellectual) :- বৌদ্ধিক বিকাশের জন্য ভাষা, সাহিত্য, বিজ্ঞান, গনিত, ভূগোল প্রভৃতি বিষয়ে শিক্ষা প্রদান।
খ) নান্দনিক (Aesthetic) :- নান্দনিক বিকাশের জন্য থাকবে চারুকলা, কবিতা, সঙ্গিত, অঙ্কন প্রভৃতি।     
গ) নৈতিক (Moral) :- নৈতিক বিকাশের জন্য পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত হবে ধর্মনীতি, দর্শনশাস্ত্র ইত্যাদি বিষয়।
 
 
ভাববাদ ও শিক্ষণ পদ্ধতি
শিক্ষা পদ্ধতির ক্ষেত্রে ভাববাদী দর্শনের প্রভাব অকিঞ্চিৎকর। এখানে তাদের কোন উল্লেখযোগ্য অবদান নেই। শিক্ষার লক্ষ্যের ক্ষেত্রে অনেক উচ্চ আদর্শের নির্দেশ দিলেও কিভাবে সেই আদর্শগুলি বাস্তবে রূপায়িত করা যাবে তার সম্বন্ধে সুনিশ্চিত কিছু বলেননি, কিন্তু তাও ভাববাদীদের মতে শিক্ষার লক্ষ্য যেহেতু, শিশুর অন্তর্নিহিত সত্তার পরিপূর্ণ বিকাশ। তাই তাঁরা শিক্ষাপদ্ধতির ক্ষেত্রে আত্মসক্রিয়তার নীতিকে গুরুত্ব দিয়েছেন। যেমন- পেস্টালৎসি নীতি ও ধর্ম শিক্ষার উপরে আত্মসক্রিয়তাকে কাজে লাগিয়েছেন, অপরপক্ষে ফ্রয়েবেল খেলা-উপহার ও কর্মকে অবলম্বন করে আত্মউন্মেষণের পথে আত্মসক্রিয়তার নীতিকে গ্রহন করেছেন। 
 
 
ভাববাদ ও শৃঙ্খলা
ভাববাদী দার্শনিকগণ অবাধ শৃঙ্খলার পক্ষপাতী নন, তাঁরা মনে করেন, আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে আত্মপলব্ধি সম্ভব। তাই কঠোর নিষ্ঠা ও নিয়মানুবর্তিতার শৃঙ্খলে তাদের বাঁধতে চান। অনেক ভাববাদীরা আবার আত্মনিগ্রহের মাধ্যমে শৃঙ্খলা বজায় রাখার কথা বলেছেন। কারন বিশৃঙ্খল মানসিক পরিমণ্ডলের মধ্যে আত্মপলব্ধি অসম্ভব। আবার অনেক ভাববাদী, শিক্ষকের ভূমিকাকে এক্ষেত্রে প্রধান করে দেখেছেন। তাঁদের মতে, আচরণবিধির যে আদর্শ ছাত্রদের সামনে উপস্থাপিত হবে, তাই ছাত্রদের সমস্ত কার্যাবলীতে নিয়ন্ত্রণ করবে। ফ্রয়েবেল-এর মতে, “Control over the child is to be exercised through a knowledge of his interests and expression of love and sympathy”. তবে যাই হোক কিছু ক্ষেত্রে স্বাধীনতার অনুমোদন দিলেও, ভাববাদী দার্শনিকরা কঠোর শৃঙ্খলাতেই বিশ্বাসী ছিলেন।
 
 
ভাববাদ ও শিক্ষকের ধারনা
ভাববাদী দার্শনিকদের মতে, সার্থক শিক্ষক হবেন তিনি, যার আত্মপলব্ধি পূর্ণ হয়েছে। তিনি হবেন আদর্শপরায়ণ, চরিত্রবান এবং উন্নত ব্যক্তিত্বের অধিকারী। শিক্ষক তার ব্যক্তিত্বের প্রভাবে শিক্ষার্থীকে উদ্বুদ্ধ করবে। তাঁর কাজ শুধু জ্ঞান বিতরণ করা নয়, নিজের জীবনের যে উপলব্ধি তিনি লাভ করেছেন শিক্ষার্থীর জীবনেও যাতে তাকে সর্বত্র সঞ্চারিত করতে পারেন, তার জন্য চেষ্টা করে যাওয়া। তাঁকে শিক্ষার্থীর মনে গভীর ছাপ রেখে যেতে হবে। সম্ভবত ভাবাদর্শকে সমান রেখে তিনিই শিক্ষার্থীদের পরিচালক, বন্ধু ও পথপ্রদর্শকের (Friend, Philosopher and Guide) কাজ করে যাবেন।
 
 
শিক্ষায় ভাববাদী দর্শনের সীমাবদ্ধতা
১) ভাববাদী দর্শন তাত্ত্বিক জ্ঞানের উপর অধিক গুরুত্ব দেয়, তাই এটি তত্ত্ব ভাড়াক্রান্ত দর্শন।
 
২) ভাববাদী শিক্ষায় শিক্ষার লক্ষ্য ভালোভাবেই বর্ণিত হয়েছে, কিন্তু শিক্ষাদান পদ্ধতিতে এই দর্শন বেশিদূর অগ্রসর হতে পারেনি।
৩) ভাববাদী দর্শন শিক্ষার পাঠক্রমের ক্ষেত্রে বাস্তবতাকে খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি, জ্ঞানের উপর অতিরিক্ত গুরুত্ব আরোপ করেছে। শিক্ষাকে পুস্তককেন্দ্রিক করে তুলেছে।
৪) ভাববাদী দর্শনে শৃঙ্খলার উপর যে কঠিন বিধিনিষেধ রয়েছে তা বর্তমান শিক্ষাবিদদের কাছে গ্রহণীয় নয়। যদি শিক্ষার্থীকে স্বাধীনতা না দেওয়া হয়, তাহলে তার সুসামঞ্জস্য বিকাশ হতে পারে না।
 
৫) ভাববাদী দর্শনে শিক্ষার্থীর তুলনায় শিক্ষককে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এই মতবাদ অনুযায়ী শিক্ষক শিক্ষার্থীকে গড়ে পিটে তৈরি করবেন এবং কঠিন শৃঙ্খলার মধ্যেদিয়ে তাদের ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন করবেন, কিন্তু বর্তমান শিক্ষকের কাছে এই মতবাদ গ্রাহ্য নয়।

৬) শিক্ষার আদর্শ এই মতবাদ অনুযায়ী অত্যন্ত উচ্চ এবং প্রকৃতপক্ষে তা আয়ত্ব করা সম্ভব নয়।শিক্ষার্থী এই উচ্চ আদর্শ সম্বন্ধে সচেতন নয় বলে তাদের কাছ থেকে সক্রিয় সহযোগিতা পাওয়া সম্ভব নয়। 

 
 
শিক্ষায় ভাববাদী দর্শনের অবদান
১) ভাববাদী দর্শনে বস্তুজগৎ অপেক্ষা শিশুর মন ও আত্মার উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করেছে ফলে শিক্ষার লক্ষ্য হিসেবে শিক্ষার্থীর পরিপূর্ণ বিকাশ প্রধান হয়ে উঠেছে।
 
২) ভাববাদী দর্শন স্বচ্ছ, সরল জীবনযাপন এবং উন্নত বুদ্ধি-বিচারশক্তির উপর গুরুত্ব প্রদান করেছে।
 
৩) ভাববাদী দর্শনের পাঠক্রমে নৈতিক বিষয় স্থান পেয়েছে। যা শিক্ষার্থীকে সামাজিক মূল্যবোধ ও উন্নত চরিত্র গঠনে সহায়তা করবে।
 
৪) আদর্শ সমাজ গঠন এবং ব্যক্তির পরিপূর্ণ ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য সর্বজনীন শিক্ষার উপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। 
 
৫) ভাববাদী দর্শনে শিক্ষককে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। শিক্ষক শিক্ষার্থীর সহায়ক ও পথনির্দেশক রূপে ভূমিকা পালন করেন। তাঁর আদর্শকে অনুসরণ করে শিক্ষার্থী তাঁর জীবনাদর্শ গড়ে তোলে। 


পরিশেষে বলা যেতে পারে, ভাববাদীরা শিক্ষাক্ষেত্রে সুউচ্চ ও মহৎ আদর্শের পরিকল্পনা করছেন। ব্যক্তিত্বের বিকাশের মাধ্যমে এই মূল্যবোধ অর্জনের উপরে গুরুত্ব আরোপ করেছেন। শিক্ষাকে সংকীর্ণতার সীমা থেকে বিশ্বজনীনতার ব্যাপক ক্ষেত্রে পরিচালিত করতে চেয়েছেন আর বিশ্বাত্মার সঙ্গে মানবাত্মার মিলন ঘটিয়ে মানুষের জীবনকে পূর্ণতার পথে নিয়ে যেতে চেয়েছেন। তবে একথা সত্য যে শিক্ষার্থীর এই মহৎ ভাব কল্পনা ও বিমূর্ত আদর্শ অর্জন করা সহজ নয়। তাই অনেক শিক্ষাবিদ সমালোচনা করে বলেছেন যে, ভাববাদীরা শিক্ষার ক্ষেত্রে যে লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন তাই চিরকাল আমাদের স্বর্ণমৃগের সন্ধানে নিযুক্ত করে রাখবে, উদ্দেশ্যর বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। 
 
 
  
 
 
 
সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি :-
  • রায়, সুশিল। শিক্ষাতত্ত্ব ও শিক্ষাদর্শন। সোমা বুক এজেন্সী, পৃষ্ঠা : ১১৪-১১৭
  • বন্দ্যোপাধ্যায়, অর্চনা। শিক্ষাদর্শন ও শিক্ষানীতি। বি. বি. কুন্ডু গ্র্যান্ড সন্স, পৃষ্ঠা : ৮৫-৯১
  • পাল, ড. অভিজিৎ কুমার। শিক্ষাদর্শনের রূপরেখা। ক্লাসিক বুকস, পৃষ্ঠা : ৬৯-৭৪
  • ঘোড়াই, নিমাই চাঁদ। শিক্ষাদর্শন ও সামাজিক শিক্ষা। সাঁতরা পাবলিকেশন প্রাইভেট লিমিটেড, পৃষ্ঠা : ১২৪-১২৯
  • পাল, ড. গোবিন্দ পদ ও মিত্র, ড. গঙ্গারাম। দর্শন ও সমাজ বিজ্ঞানের ভিত্তি। নব প্রকাশনী, পৃষ্ঠা : ২৫-৩০ 
____________________________________