Kd's e-pathsala Introduction to Education শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার ধারণা, বৈশিষ্ট্য ও তাৎপর্য

শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার ধারণা, বৈশিষ্ট্য ও তাৎপর্য



আধুনিকশিক্ষা গতানুগতিক শিক্ষা থেকে অনেক দূরে সরে এসেছে। এককালে শিক্ষার লক্ষ্য, পদ্ধতি, পাঠক্রম, ধ্যানধারনা যা ছিল তার সবকিছুর আমূল পরিবর্তন ঘটে গেছে। অষ্টাদশ শতকে ইউরোপে মানুষের চিন্তার জগতে এক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। এবং সেই আলোড়নের প্রভাব পড়ে উনবিংশ শতকে। এই শতকে শিক্ষা সম্পর্কে বহু ধ্যানধারণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়। এর ভিতর দিয়ে শিক্ষা অনেকটা আধুনিকতার পথে যায়। শিক্ষায় এই আধুনিক হওয়ার পিছনে মূল তিনটি ধারণা কাজ করেছিল। এই ধারনাগুলির একটি হল মনোবৈজ্ঞানিক ধারা, এবং অপর দুটি হল- বৈজ্ঞানিক ধারা, এবং সমাজ বিজ্ঞানের ধারা। প্রথম ধারাটির প্রভাবে শিক্ষা হয়েছে শিশুকেন্দ্রিক। অর্থাৎ শিশুকে কেন্দ্র করে সম্পূর্ণ শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। শিশুর সর্বাঙ্গীণ বিকাশকে তরান্বিত করতে গিয়ে শিশুর আগ্রহ, রুচি ও প্রবণতাকে গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষার পরিচালনার ব্যবস্থা হয়েছে। অর্থাৎ বাইরে থেকে কোন কিছু জোড় করে শিক্ষার্থীর উপর চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। তার নিজের চাহিদা এবং যে সমাজে সে বাস করে সেই সমাজের চাহিদার মধ্যে সমন্বয় সাধন করে শিক্ষা গড়ে তুলতে হবে। স্বাভাবিকভাবে এই ধারার প্রভাবে শিক্ষার তাৎপর্য, লক্ষ্য, পদ্ধতি সবকিছু পরিবর্তিত হয়ে যাবে। 

 

 

শিক্ষায় শিশুকেন্দ্রিকতা

রোমান চিন্তাবিদ কুইন্টিলিয়ান, রেনেসাঁ যুগের চিন্তাবিদ ইরাসমাস, কমেনিয়াস প্রমুখ শিশুকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য শিক্ষার্থীর কথা বেশি করে ভাবতে বলেছিলেন। কিন্তু শিশুর মুক্তি ঘটেনি। সেই আদিমকাল থেকেই শিক্ষাকে তার উপর জোড় করে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। শিশুর প্রথম মুক্তি ঘটল অষ্টাদশ শতকে শিক্ষায় শিশুকেন্দ্রিকতার ধারণার মধ্যেদিয়ে এবং তাত্ত্বিক দিক থেকে এই শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার জনক হলেন রুশো। শিশুকে স্বাধীনতা দিয়ে তাকে শিক্ষাদানের যে ভাবনা শিশুর মধ্যে ছিল তাকে বাস্তব রুপ দিয়েছিলেন পেস্তালৎসি, হারবার্ট, ফ্রয়েবেল প্রমুখ মনীষীরা। সুতরাং এই ধারণার উৎপত্তি যে আজ হঠাৎ করে ঘটেছে তা নয়, প্রাচীনকালে নানান মনীষীদের চিন্তাধারার ফল হল এই শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা।  

 

এই প্রকার শিক্ষা রচিত হয়েছে শিশুর আগ্রহ, চাহিদা ও সামর্থ্যকে কেন্দ্র করে। এই প্রকার শিক্ষার প্রধান কেন্দ্রবিন্দু হল শিশু, যাকে কেন্দ্র করে সমস্ত শিক্ষা প্রক্রিয়া রচিত হয়ে থাকে। নিম্নে একটি চিত্রের মাধ্যমে এটি দেখানো হল-  

গতানুগতিক শিক্ষায় যেখানে শিক্ষার কেন্দ্রবিন্দু ছিল শিক্ষক, তাঁকে ঘিরেই সমস্ত শিক্ষাপ্রক্রিয়া পরিচালিত হত। যেখানে শিক্ষার কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন শিক্ষক। যেখানে শিশুর আগ্রহ, চাহিদা ও সামর্থ্যকে গুরুত্ব দেওয়া হত না। কিন্তু বর্তমানে শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষায় একজন শিশু শিক্ষাক্ষেত্রে সম্পূর্ণরূপে স্বাধীনতা ভোগ করে এবং শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে ব্যক্তি স্বাধীনতাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়ে থাকে। 


 

শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার বৈশিষ্ট্য

প্রাচীন ধারণা আনুযায়ী শিক্ষা ছিল জ্ঞান আহরণের প্রক্রিয়া মাত্র। শিক্ষক জ্ঞানের ভাণ্ডার তিনি তার উর্ধিত জ্ঞান শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণ করতেন। শিক্ষার্থীদের কাজ ছিল সেই জ্ঞান আহরণ করা কিন্তু শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষায় শিশুর ধারণাকে অনেক বেশি ব্যাপক ও তাৎপর্যপূর্ণ অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষের যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের প্রক্রিয়া চলেছে তাই হল শিক্ষা। ফলে শিশুর কাছে শিক্ষা হল একধরণের অভিযোজনের প্রক্রিয়া। শিক্ষার এই তাৎপর্য শিশুকেন্দ্রিকতার ধারণার ক্ষেত্রে পরিপূর্ণতা দান করেছে। নিম্নে শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করা হল- 

 

  1. স্বাধীনতার স্বীকৃতি : শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ একটি বৈশিষ্ট্য হল একজন শিশুকে অবাধ স্বাধীনতা দান। এখানে শিশুর উপর জোড় করে কিছু চাপিয়ে দেওয়া হয় না, এখানে শিক্ষার্থী শিক্ষাগ্রহণের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণরূপে স্বাধীনতা ভোগ করে। এক্ষেত্রে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে কর্মে প্রেরণা বজায় রাখার জন্য এই স্বাধীনতা প্রদান করা হয়ে থাকে।
  2. মুক্ত শৃঙ্খলা : শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার মূল মন্ত্রই হল মুক্ত বা স্বতঃস্ফূর্ত শৃঙ্খলা। আগের বৈশিষ্ট্যতে বলা হয়েছে, এখানে শিক্ষার্থীর উপর কোন কিছু জোড় করে চাপিয়ে দেওয়া হয় না, অর্থাৎ এখানে শিশু সকল প্রকার বাহ্যিক নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত। এখানে শিশুরা নিজ হতে প্রকৃত স্বাধীনতার অর্থ অনুধাবন করার মধ্যে দিয়ে নিজেদের শৃঙ্খলিত করে থাকে। এর ফলে একজন শিশুর স্বাভাবিক অত্মপ্রকাশ কোনোভাবেই বাধাপ্রাপ্ত হয় না। 
  3. ব্যাক্তিকেন্দ্রিক পাঠদান : শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষায় একজন শিশুর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য-কে সম্পূর্ণরূপে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়ে থাকে। প্রত্যেক শিশুরা একে অপরের থেকে ভিন্ন, এবং তাদের আগ্রহ, চাহিদা এবং সামর্থ্যও ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। সেহেতু শিশুর নিজস্বতার উপর ভিত্তি করে সম্পূর্ণ শিক্ষা প্রদান করাই হল শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। এটি সম্পূর্ণরূপে মনোবিজ্ঞান স্বীকৃত।
  4. চাহিদা কেন্দ্রিক : এই প্রকার শিক্ষায় একজন শিশুর চাহিদাকে প্রাথমিকভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়। মনোবিদ্যা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে স্বীকার করে, শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষায় তার সমর্থন রয়েছে। এখানে একজন শিশুকে তার চাহিদা ও সামর্থ্য অনুযায়ী শিক্ষা প্রদান করা হয়ে থাকে।
  5. সৃজনাত্মক ক্ষমতার উন্মেষ : এই প্রকার শিক্ষায় শিক্ষার্থীকে সম্পূর্ণরূপে স্বাধীনতা প্রদান করার মধ্যেদিয়ে শিশুর সৃজন ক্ষমতার বিকাশের চেষ্টা করা হয় এবং বিভিন্ন কাজের মধ্যেদিয়ে শিশুর সৃজনাত্মক ক্ষমতার উন্মেষ সাধন করা হয়। একজন শিশুর সৃজনাত্মক ক্ষমতার উপর সমাজের অগ্রগতি নির্ভর করে।
  6. সর্বাঙ্গীণ বিকাশ : আধুনিক শিক্ষার প্রধানতম লক্ষ্য হল একজন শিশুর সর্বাঙ্গীণ বিকাশ সাধন করা, শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষায়ও এর প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষায় একজন শিশুর দৈহিক, মানসিক, সামাজিক, নৈতিক, আধ্যাত্মিক বিকাশ সাধনের মধ্যেদিয়ে একজন শিশুকে পরিপূর্ণ মানুষ হিসাবে গড়ে তোলা হয়। 

 


 

শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার তাৎপর্য 

জ্ঞান বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার পথপ্রদর্শক হল দর্শন। শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার তাৎপর্য কতখানি তার বিচার বিশ্লেষণের প্রথমেই দার্শনিক কয়েকটি বিশেষ শাখার মতামতকে প্রাধান্য দেওয়া হয়ে থাকে। 

  • ভাববাদে শিক্ষার লক্ষ্য হিসাবে আত্মউন্মেষণের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ-কে গ্রহণ করা হয়েছে। এখানে ‘শিশু অসীম শক্তি সম্পন্ন’ একথা প্রকাশিত হয়েছে। অসীম শক্তির আধার বিকাশমান শিক্ষার্থীর শিক্ষা মূলত তার বিভিন্ন গুণাবলীর বিকাশের সহায়ক হবে একথা অনস্বীকার্য। শিক্ষার্থীকে কেন্দ্র করেই শিক্ষার লক্ষ্য, পাঠক্রম, পদ্ধতি আরও নানা উপকরণ পরিবেশিত হবে।
  • দর্শনের আরেক শাখা জৈব প্রকৃতিবাদ শিশুর মনস্তাত্ত্বিক প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্যর প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। তাই সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে শিক্ষা প্রক্রিয়া, পাঠক্রম, পদ্ধতি সবই শিশুর মনস্তাত্ত্বিক প্রকৃতিকে অনুসরণ করে প্রাকৃতিক পরিবেশে পরিচালিত হওয়াই একান্তভাবে কাম্য।
  • ভাববাদ প্রকৃতিবাদের মতোই প্রয়োগবাদ শিক্ষায় শিক্ষার্থীর স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশের ধারাকে লক্ষ্য রেখেই শিক্ষা প্রক্রিয়া গড়ে তোলার প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন। সমাজ ও ব্যক্তিজীবন, মূল্যবোধ ইত্যাদি কোন কিছু থেমে নেই, তাই শিক্ষার্থীর জন্য পূর্বপরিকল্পিত কোন পাঠক্রম বা পদ্ধতি নির্দিষ্ট হতে পারে না। শিক্ষার্থী তার জীবন অভিজ্ঞতার মধ্যেদিয়ে শিখবে। শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা এই মতানুসারে তাই তাৎপর্যপূর্ণ। আধুনিক দর্শনের মূল কথা হল- ব্যক্তি স্বাধীনতা। প্রতি ব্যক্তি নির্ধারণ করবে তার চলার পথ। সেই জন্য সম্পূর্ণ শিক্ষাপ্রক্রিয়া তার সামর্থ্য, রুচি, আগ্রহ, প্রবণতাকে ঘিরে গড়ে উঠবে। 
  • শারীরবিদ্যার দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে দেখা যাবে প্রতি দেহ, তার গঠন, বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ও তাদের কর্মপ্রণালী একেবারেই ভিন্ন। মস্তিষ্কের গঠন, স্নায়ু, সুষুম্নাকান্ড, অন্তঃক্ষরা গ্রন্থির ক্ষরণ সবই প্রত্যেকের ক্ষেত্রে আলাদা। ফলে তাদের প্রভাব মানসিক গঠনের উপর পড়তে বাধ্য, তাই শিক্ষার সরঞ্জাম শারীরিক ব্যক্তিবৈষম্যকে কেন্দ্র করে গড়ে তুলতে হবে।
  • সমাজবিদ্যার দিক থেকে বিচার করলে দেখা যায়, ব্যক্তিবৈষম্য অনুসারে সুষম শিক্ষার দ্বারা শিক্ষিত সুসংহত ব্যক্তি মানুষই সুস্থ সমাজ গড়ে তোলে। শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক শিক্ষাই সেই স্বাধীন সমন্বিত ব্যক্তিত্ব গঠন করতে পারে, তবেই মানবজাতির উন্নতি হবে। শিক্ষাবিদ পার্সি নান বলেছেন, ‘পুরুষ ও নারীর স্বাধীন কাজকর্মের পরিবেশ না থাকলে সুস্থ মানবসমাজ গড়ে উঠতে পারে না’।

 

এতক্ষণ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার যে তাৎপর্য অলোচনা করা হল। কিন্তু আজ একবিংশ শতকেও শিশুকেন্দ্রিকতা শিক্ষাক্ষেত্রে কতখানি বাস্তবায়িত তা ভাববার বিষয়। উন্নত দেশগুলি বাদ দিয়ে নিজের দেশের মত উন্নয়নশীল দেশে আজও জীবন ও শিক্ষা সমার্থক নয়। পাঠক্রম তত্ত্ব ও তথ্য বহুল, পদ্ধতিতে এখন মুখস্থ বিদ্যার প্রাধান্য। এত কিছু সমস্যা বাঁধা-বিপত্তি থাকা সত্ত্বেয় আমাদের দেশ, জনজীবন, প্রশাসন একান্তভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কীভাবে এই সমস্যার নিস্পত্তি করা সম্ভব। 

______________________________