Kd's e-pathsala Introduction to Education শিক্ষার ব্যুৎপত্তিগত অর্থ, সংজ্ঞা, বৈশিষ্ট্য এবং শিক্ষার সংকীর্ণ ও ব্যাপক অর্থ

শিক্ষার ব্যুৎপত্তিগত অর্থ, সংজ্ঞা, বৈশিষ্ট্য এবং শিক্ষার সংকীর্ণ ও ব্যাপক অর্থ



মানবজীবন এক নিরবিচ্ছিন্ন স্রোতধারা, সেই আদিম যুগ থেকে বর্তমানকালে নানান পরিবর্তনের মধ্যেদিয়ে সে আজ এই জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। তার এই পথচলার সঙ্গী হল শিক্ষা, যা মানবকে উন্নততর জীবনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার রসদ জুগিয়ে থাকে। শিক্ষা মানুষকে নতুন মূল্যবোধের সাথে পরিচয় করার এবং পুরানোর সাথে নতুন মূল্যবোধের স্বার্থক সমন্বয় সাধনে সহায়তা করে। শিক্ষা হল এমন একটি প্রক্রিয়া যা ব্যক্তির আচরণে পরিবর্তন আনে, তার আচরণকে পরিমার্জন, পরিশোধনের মধ্যেদিয়ে পরিবর্তনশীল সমাজের সাথে সংগতিবিধানে সহায়তা করে থাকে। শিক্ষার মাধ্যমেই ব্যক্তি পরিপূর্ণ জীবনের অধিকারী হয়। 

 

 

শিক্ষার ব্যুৎপত্তিগত অর্থ

শিক্ষার ব্যুৎপত্তিগত অর্থ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, ‘শিক্ষা ‘ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ‘শাস্’ ধাতু থেকে। এর অর্থ হল শাসন করা, শৃঙ্খলিত করা বা নিয়ন্ত্রণ করা। অর্থাৎ শিক্ষা বলতে বোঝায় মার্জিত আচরণকে। শিক্ষাকে আমরা ‘বিদ্যা’ অর্থেও গ্রহণ করে থাকি, যা এসেছে সংস্কৃত ‘বিদ্’ ধাতু থেকে, যার অর্থ হল বিদ্যা বা জ্ঞান আহরণ করা। আবার শিক্ষার ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘Education’ শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ ‘Educare’, ‘Educere’, ‘Educatum’, ‘Educo’ থেকে। ‘Educare’ কথাটির অর্থ হল প্রতিপালন

বা  পরিচর্চা করা। ‘Educere’ কথাটির অর্থ হল ভিতর হতে বের করে আনা বা বিকাশসাধন করা। ‘Educatum’ যার অর্থ হল নির্দেশনা বা পরিচালনা। ‘Educo’ যার অর্থ হল Educere এর সমগ্র অর্থাৎ প্রকাশ করা বা বের করে আনা। উপরি চারটি ব্যুৎপত্তিগত অর্থের মধ্যে ‘Educare’, ‘Educatum’, ‘Educo’-এই তিনটি ধারণা সংকীর্ণ অর্থে ব্যবহৃত হয়, কিন্তু ‘Educere’ শব্দের অর্থ অপেক্ষাকৃত ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়।

  

শিক্ষার সংজ্ঞা

বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন দার্শনিক, শিক্ষাবিদ বিভিন্নভাবে শিক্ষার মর্মার্থকে বিশ্লেষণ করে, তাঁদের নিজ বক্তব্য দিয়েছেন, এগুলি আলোচনা করলে আমাদের কাছে শিক্ষার ধারণাটি আরও পরিস্ফুট হবে। নিম্নে সেগুলি উল্লেখ করা হল-

 

পাশ্চাত্য দার্শনিক ও শিক্ষাবিদগণ কতৃক প্রদত্ত সংজ্ঞা-

অ্যারিস্টটলের মতে, ‘সুস্থ দেহ ও সুস্থ মন তৈরি করাই হল শিক্ষা’।

প্লেটোর মতে, ‘শিক্ষা শিশুর নিজের ক্ষমতা অনুযায়ী, মনের সার্বিক বিকাশে সাহায্য করে’।

রুশো বলেছেন, ‘শিক্ষা হল শিশুর স্বতঃস্ফূর্ত আত্মবিকাশ’।

হার্বাট স্পেনসর বলেছেন, ‘শিক্ষা হল মানুষের ভবিষ্যৎ জীবনযাপনের প্রস্তুতি মাত্র’।

মন্তেসরির মতে, ‘শিশুর স্বাভাবিক জীবন বিকাশের জন্য যে সহায়তা দেওয়া হয়, তাই হল শিক্ষা’।

ফ্রয়েবেলের মতে, ‘শিক্ষা হল সেই বিকাশের প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে ব্যক্তি প্রকৃতির রাজ্যে নিজের বিস্তৃতি ঘটায় ও মনুষ্য সমাজের সঙ্গে নিজের সত্তাকে একীভূত করে’।

 

প্রাচ্য দার্শনিক ও শিক্ষাবিদগণ কতৃক প্রদত্ত সংজ্ঞা-

মহাত্মা গান্ধীর দৃষ্টিতে, ‘শিক্ষা হল শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তির দেহ, মন ও আত্মার মহৎ গুনের পরিপূর্ণ ও সামঞ্জস্য বিবরণ’।

ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ শিক্ষা প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘ভারতীয় ঐতিহ্য অনুসারে শিক্ষা কেবলমাত্র জীবিকা অর্জনের পন্থা মাত্র নয়, এমনকি চিন্তা ও ভাবের সূতিকাগৃহ বা নাগরিকত্ব অর্জনের প্রতিষ্ঠানও নয়। এ হল জীবনের প্রবর্তনা, সত্যানুসন্ধান ও ধর্মাচরণে দীক্ষালাভ’।

স্বামী বিবেকানন্দের মতে, ‘শিক্ষা হল ব্যক্তির অন্তর্নিহিত সত্তার পরিপূর্ণ বিকাশ’।

মহাত্মা গান্ধীর দৃষ্টিতে, ‘শিক্ষা হল শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তির দেহ, মন ও আত্মার মহৎ গুনের পরিপূর্ণ ও সামঞ্জস্য বিবরণ’।

রবীন্দ্রনাথের মতে, ‘শ্রেষ্ঠ শিক্ষা হল তাই যা কেবল তথ্য পরিবেশন করে না, যা বিশ্বসত্ত্বার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের জীবনকে গড়ে তোলে’।

শ্রী অরবিন্দের বলেছেন, ‘শিক্ষা ব্যক্তির অন্তর্নিহিত জাগ্রত আত্মার বিকাশসাধন’।

ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ শিক্ষা প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘ভারতীয় ঐতিহ্য অনুসারে শিক্ষা কেবলমাত্র জীবিকা অর্জনের পন্থা মাত্র নয়, এমনকি চিন্তা ও ভাবের সূতিকাগৃহ বা নাগরিকত্ব অর্জনের প্রতিষ্ঠানও নয়। এ হল জীবনের প্রবর্তনা, সত্যানুসন্ধান ও ধর্মাচরণে দীক্ষালাভ’।

 

উপরিউক্ত বিভিন্ন দার্শনিক ও শিক্ষাবিদগণের সংজ্ঞাগুলি বিশ্লেষণে এর কতকগুলি বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়, যে গুলি নিম্নে উল্লেখ করা হল- 

 

 

১) শিক্ষা হল একটি সংযোগ সাধনকারী প্রক্রিয়া যা বিভিন্ন উপাদানের মধ্যে সংযোগসাধন করে থাকে, এছাড়া শিক্ষাকে একটি বহুমুখী প্রক্রিয়াও বলা হয়ে থাকে কারণ এটি শিক্ষার্থী, শিক্ষক, পাঠ্যক্রম এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে। নিম্নে একটি চিত্রের মাধ্যমে দেখানো হল।

 

২) শিক্ষা হল জ্ঞানার্জনী প্রক্রিয়া। শিক্ষার্থী তার অভিজ্ঞতা বৃদ্ধির জন্য জ্ঞান অর্জন করে, এক্ষেত্রে শিক্ষার্থী সক্রিয়ভাবে জ্ঞান অর্জন করতে পারে তার জন্য শিক্ষা তাকে সাহায্য করে।
৩) শিক্ষা শাশ্বত মূল্যবোধের আবিষ্কারে সাহায্য করে, যার দ্বারা শিক্ষার্থীর মূল্যবোধের বিকাশ ঘটে।
৪) শিক্ষা একটি মিথস্ক্রিয়ামূলক প্রক্রিয়া, যার দ্বারা শিক্ষার্থীর পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার বিকাশ ঘটে।
৫) শিক্ষা সামাজিক সংস্কৃতির ও ঐতিহ্যের সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও সঞ্চালন ঘটায়।
৬) শিক্ষার মাধ্যমে মানব সম্পদের বিকাশ ঘটে, যার সুষ্ঠু প্রয়োগে জাতির বিকাশ ঘটে।

 

উপরিউক্ত সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্যগুলি বিশ্লেষণে বলা যেতে পারে যে, শিক্ষা হল এমন একটি প্রক্রিয়া যা ব্যাক্তির আচরণে পরিবর্তন আনে এবং তাকে পরিবর্তনশীল পরিবেশের সাথে সার্থক অভিযোজনে সহায়তা করে।

 

 

শিক্ষার অর্থ 

প্রাচীনকালে ‘শিক্ষা’ বলতে বই মুখস্থ করে জ্ঞানার্জন করা এবং তা ব্যবহার করে সেই জ্ঞানের ভিত্তিতে পরীক্ষায় পাস করে ডিগ্রী বা ডিপ্লোমা পাওয়াকে বোঝানো হত, কিন্তু বর্তমানে এই ধারণার পরিবর্তন হয়েছে, বর্তমান শিক্ষা শুধুমাত্র পুস্তক থেকে জ্ঞানার্জন করা নয়, কিংবা ডিগ্রী কিংবা ডিপ্লোমা লাভের শিক্ষাও নয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে বিচারে শিক্ষার দুই প্রকার অর্থ পরিলক্ষিত হয়। যথা-

 

 শিক্ষার সংকীর্ণ অর্থ

যে শিক্ষায় অপরিপক্ক বা অপরিণত মনকে ভারাক্রান্ত করে তোলা হয়, তাই হল সংকীর্ণ অর্থে শিক্ষা। এই ধরনের শিক্ষায় কোন নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পুঁথিগত জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে ডিগ্রী কিংবা ডিপ্লোমা অর্জন করে থাকে। এই ধরনের শিক্ষায় শিক্ষার্থীর আগ্রহ ও চাহিদা অবহেলিত হয়ে থাকে। এছাড়া শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে সম্পর্ক হয় দাতা ও গ্রহীতার, এই সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে সংকীর্ণ অর্থে শিক্ষার কতকগুলি তত্ত্ব গড়ে উঠেছে। যেমন- স্বর্ণ থলির তত্ত্ব, জলনল তত্ত্ব। নিম্নে একটি চিত্রের মধ্যে জলনল তত্ত্বটি দেখানো হল-

চিত্র: জলনল তত্ত্ব 

 

 সংকীর্ণ অর্থে শিক্ষার বৈশিষ্ট্য 

  1. এই প্রকার শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য হল শুষ্ক জ্ঞানদানের মাধ্যমে শিশুর জ্ঞানভাণ্ডার কে বৃদ্ধি করা। 
  2. সংকীর্ণ অর্থে শিক্ষা বলতে বিদ্যালয়ে অর্জিত জ্ঞানকে বোঝানো হয়ে থাকে।
  3. এই প্রকার শিক্ষার একটি সামাজিক স্বীকৃতি আছে, শিক্ষান্তে ডিগ্রী ও ডিপ্লোমা প্রদান করা হয়।
  4. এই প্রকার শিক্ষায় শিক্ষার্থীর আগ্রহ, চাহিদা ও সামর্থ্য অবহেলিত হয়।
  5. এই প্রকার শিক্ষায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যেকার সম্পর্ক দাতা এবং গ্রহীতার।
  6. সংকীর্ণ অর্থে শিক্ষা প্রয়োজন মাফিক। প্রয়োজন অনুসারে কোন বিষয়ে দক্ষতা কিংবা পারদর্শিতা অর্জনের মধ্যেই এই শিক্ষা সীমাবদ্ধ।
  7. এই প্রকার শিক্ষা হল ভবিষ্যৎ জীবনের প্রস্তুতি মাত্র।

 

শিক্ষার ব্যাপক অর্থ

ব্যাপক অর্থে শিক্ষা হল একটি জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া। এই শিক্ষা মানুষের জন্মের পর থেকে শুরু হয় এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত চলতে থাকে। ব্যাপক অর্থে শিক্ষার তাৎপর্য হল শিশুর অন্তর্নিহিত সুপ্ত সম্ভাবনার বিকাশসাধন। এই প্রকার শিক্ষা কোন নির্দিষ্ট পরিবেশে সীমিত সময়ের প্রশিক্ষণ নয়। শিক্ষাবিদ রেমন্ট বলেছেন, ব্যাপক অর্থে শিক্ষা শিশুর শৈশব থেকে পরিপক্কতার স্তর অবধি একটি বিশেষ প্রক্রিয়া, যার সাহায্যে মানুষ প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশের সঙ্গে মানুষ সঙ্গতিবিধানে সক্ষম হয়। 

  

ব্যাপক অর্থে শিক্ষার বৈশিষ্ট্য

  1. ব্যাপক অর্থে শিক্ষা সমগ্র জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া। এই প্রকার শিক্ষা ব্যাক্তির জীবনের সাথে সমব্যাপী।
  2. ব্যাপক অর্থে শিক্ষা হল অভিজ্ঞতার পুনর্গঠন ও পুনঃসৃজন।
  3. এই ধরনের শিক্ষায় কোন অভিজ্ঞতা শিক্ষার্থীর উপর জোড় করে চাপিয়ে দেওয়া হয় না। এখানে শিক্ষার্থীর আগ্রহ, চাহিদা ও সামর্থ্যকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়ে থাকে।
  4. ব্যাপক অর্থে শিক্ষা অর্জিত হয় বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং বাস্তব সমস্যার সমাধানের মাধ্যমে।
  5. ব্যাপক অর্থে শিক্ষা ব্যক্তির অবাঞ্ছিত আচরণগুলিকে পরিত্যাগ করে, নতুন আচরণ সম্পাদন করার যোগ্যতা দান করে।
  6. ব্যাপক অর্থে শিক্ষায় শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়ই সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
  7. ব্যাপক অর্থে শিক্ষা শিশুকে সামজিক মূল্যবোধের শিক্ষা প্রদান করে।

 

 

সংকীর্ণ ও ব্যাপক অর্থে শিক্ষার মধ্যে পার্থক্য

  1. জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনই হল সংকীর্ণ অর্থে শিক্ষা, কিন্তু শিশুর সকল রকম সম্ভাবনার পরিপূর্ণ বিকাশই হল ব্যাপক অর্থে শিক্ষা।
  2. সংকীর্ণ অর্থে শিক্ষায় পাঠ্যপুস্তককেন্দ্রিক জ্ঞান অহরনের মাধ্যমে মানসিক শক্তির বিকাশ সাধন করা হয়ে থাকে। কিন্তু ব্যাপক অর্থে শিক্ষা হল শিশুর দৈহিক, মানসিক, সামাজিক, প্রাক্ষোভিক ও নৈতিক জীবনের সামঞ্জস্যপূর্ণ বিকাশ। 
  3. সংকীর্ণ অর্থে শিক্ষা সীমিত সময়ের শিক্ষা, অপরদিকে ব্যাপক অর্থে শিক্ষা এক জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া।
  4. এই শিক্ষাপ্রক্রিয়া সুনির্দিষ্ট নিয়মমাফিক উপায়ে পরিচালিত হয়ে থাকে, অপরদিকে ব্যাপক অর্থে শিক্ষা সুনির্দিষ্ট নিয়মমাফিক উপায়ে পরিচালিত হয় না।
  5. ডিগ্রী ও ডিপ্লোমা অর্জনই প্রধানতম লক্ষ্য, সামাজিক জীবন উপযোগী শিক্ষা অর্জনই প্রধানতম লক্ষ্য।

 ___________________________