‘প্রযুক্তি’ শব্দটির ব্যবহার গত ২০০ বছরের তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। বিংশ শতাব্দীর আগে এই শব্দটি ইংরেজিতে অপরিচিত ছিল যা সাধারণত কখনো কখনো প্রয়োজনীয় কলার ব্যাখ্যা দিতে ব্যবহৃত হতো। ‘প্রযুক্তি’ শব্দটি প্রাধান্য পায় দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লবের সান্নিধ্যের মাধ্যমে। ‘Technology’ শব্দটি গ্রিক শব্দ ‘Techne’ ও ‘logia’ থেকে এসেছে, ‘Techne’ যার অর্থ হল দক্ষতা (skill) এবং ‘logia’ যার অর্থ হল বিজ্ঞান (science)। সুতরাং, ‘Technology’ কথাটির অর্থ হল ‘দক্ষতার বিজ্ঞান’। ১৯৩০-এর দশকে প্রযুক্তি কেবল ইন্ডাস্ট্রিয়াল শিল্পের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি।
১৯৩৭ সালে মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী রেড বাইন লিখেছিলেন ‘ প্রযুক্তি অন্তর্ভুক্ত করে সমস্ত মেশিন, সরঞ্জাম, যন্ত্রপাতি এবং যোগাযোগ ও পরিবহনের ডিভাইস ও দক্ষতা যা আমরা তৈরি এবং ব্যবহার করি।
পেজ (Page) এর মতে, কোনো বিশেষ ব্যবহারিক উদ্দেশ্য সাধন বা সমাধান করার জন্য বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের প্রয়োগকেই প্রযুক্তি বলা হয়।
According to the McGraw-Hill dictionary, Technology is the systematic knowledge of its application to industrial processes, closely related to engineering and science.
সম্প্রতি বিভিন্ন যান্ত্রিক কারণে অনেক বিজ্ঞানীরা ইউরোপীয় দার্শনিকদের চিন্তা ধারাকে বিবেচনা করেন প্রযুক্তিকে বিশ্লেষণ করতে যেমন করা হয়েছে ফোকল্টসের টেকনোলজিস অফ দ্যা সেলফ। অভিধান ও বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন ধরনের সংজ্ঞা দিয়ে থাকেন। মেরিয়ামিয়াম-ওয়েস্টার লার্নার্স ডিকশনারি বিষয়টির এইরকম সংজ্ঞা প্রদান করে ‘প্রযুক্তি হল শিল্প ও প্রকৌশল ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের ব্যবহার যা প্রয়োজনীয় জিনিস আবিষ্কার ও সমস্যা সমাধানে ব্যবহৃত হয়’ এবং ‘মেশিন বা সরঞ্জাম হল প্রযুক্তির তৈরি ফলাফল’।
উরসুলা ফ্রাঙ্কলিন ১৯৮৯ সালে তাঁর ‘রিয়েল ওয়ার্ল্ড অফ টেকনোলজি’ লেকচারে এই ধারণাটির অন্য একটি সংজ্ঞা দিয়েছেন ‘এটি হলো আমরা চারপাশের কাজ কিভাবে করি তার কৌশল। এটি প্রায়শই ইলেকট্রনিক্স টেকনোলজি বা উচ্চতর প্রযুক্তিকে বুঝায়’।
ডব্লিউ ব্রায়ান আর্থার একইভাবে বিস্তর পরিসরে প্রযুক্তিকে সংজ্ঞায়িত করেন, ‘একটি পদ্ধতি হিসেবে যা মানুষের উদ্দেশ্য পূরণ করে’।
বিস্তর পরিসরে প্রযুক্তি হল মানসিক ও শারীরিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে সৃষ্ট বস্তুগত ও অবস্তুগত জিনিস বা মাধ্যম যার মাধ্যমে কোনো মূল্য অর্জন করা হয়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে প্রযুক্তি হল যন্ত্র ও সরঞ্জাম যা বাস্তব জীবনের সমস্যা সমাধানে ব্যবহৃত হয়। এটি একটি সুদূরপ্রসারি ধারণা যা সরল যন্ত্র যেমন চামচ থেকে শুরু করে অনেক জটিল যন্ত্র যেমন মহাশূন্য স্টেশন ইত্যাদি কে অন্তর্ভুক্ত করে। যন্ত্র ও সরঞ্জাম কেবল বস্তুই হতে হবে তা নয় যেমন কম্পিউটার সফটওয়্যার ও ব্যবসার পদ্ধতি এগুলো প্রযুক্তির সংজ্ঞার মধ্যে পড়ে। প্রযুক্তির শব্দটি বিভিন্ন কৌশলের সংগ্রহকে ও বুঝাতে ব্যবহৃত হয়। প্রযুক্তিকে সমাজ পরিবর্তনের কার্যক্রম হিসেবে উল্লেখ করা যায়। তাছাড়া প্রযুক্তি হল গণিত, বিজ্ঞান ও কলার প্রয়োগ যা জীবনে উপকারে আসে। এর আধুনিক উদাহরণ হল যোগাযোগ প্রযুক্তির উদ্ভব যার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে শারীরিক মিথস্ক্রিয়ার বাঁধাকে অতিক্রম করে একটি নতুন সংস্কৃতি, যা সাইবার (Cyber) সংস্কৃতির নামে আবির্ভূত হয়েছে যার ভিত্তি হলো কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট।
শিক্ষা প্রযুক্তিবিদ্যার গুরুত্ব :
প্রযুক্তির মাধ্যমে যখন শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে ওঠে বা শিক্ষাদান প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয় তখন তা হয় প্রযুক্তিবিদ্যা মাধ্যমে শিক্ষা। বর্তমানে আমাদের ভারতবর্ষে শিক্ষায় প্রযুক্তির ব্যবহার যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। শিক্ষায় প্রযুক্তি ব্যবহারের বিভিন্ন রকম উদ্দেশ্য আছে। যে উদ্দেশ্যগুলি পালনের মাধ্যমে শিক্ষাপ্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। শিক্ষাক্ষেত্রে প্রযুক্তিবিদ্যা ব্যবহার করে যে সকল বিষয়গুলোতে সবচেয়ে বেশি উন্নতি লক্ষ্য করা গেছে তার মধ্যে অন্যতম শিক্ষার্থীদের আত্মপ্রকাশ শিক্ষা, মনোযোগী হয়ে ওঠা ইত্যাদি। এই কারণে শিক্ষায় প্রযুক্তিবিদ্যার যথেষ্ট ভূমিকা আছে। এখানে শিক্ষায় প্রযুক্তিবিদ্যার কয়েকটি ভূমিকা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রযুক্তিবিদ্যার যে সকল ভূমিকাগুলি উল্লেখযোগ্য এবং গুরুত্বপূর্ণ সে সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হলো –
১. শিক্ষাক্ষেত্রে প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে শিক্ষার্থীদের আত্মতৃপ্তি ঘটেছে। আত্মতৃপ্তি একটি শিক্ষার্থীকে আত্মবিকাশে সহায়তা করে। আর প্রযুক্তিবিদ্যা আত্মতৃপ্তি আনে, এটি মানুষের দেহে ও মনে অভিনবত্বের প্রকাশ ঘটাতে সক্ষম।
২. প্রযুক্তিবিদ্যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের বৌদ্ধিক ও ব্যবহারিক জ্ঞানের বিকাশ ঘটে থাকে। প্রযুক্তিবিদ্যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা তাদের নিজের চাহিদা ভিত্তিক বিষয় নির্বাচন করে সে বিষয়ে আত্মসক্রিয় হয়ে ওঠে। অর্থাৎ প্রযুক্তিবিদ্যার মাধ্যমে শিক্ষার্থী নিজের চাহিদা মেটাতে সক্ষম।
৩. প্রযুক্তিবিদ্যা ব্যবহারের ফলে বা শিক্ষায় প্রযুক্তিবিদ্যা গ্রহণ করার ফলে বিভিন্ন শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যতে বিশেষজ্ঞ প্রযুক্তিবিদ তৈরি হওয়ার পথকে সুগম করে তুলতে পারে। অর্থাৎ শিক্ষায় প্রযুক্তিবিদ্যার ব্যবহারের ফলে শিক্ষার্থীরা প্রযুক্তি সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ-তে পরিণত হতে পারে।
৪. যেকোন বিষয়ে একঘেয়েমি পাঠদান শিক্ষার্থীদের কাছে অতৃপ্তিকর হয়ে ওঠে। কিন্তু শিক্ষাদানের মধ্যে যদি প্রযুক্তির ব্যবহার করে, শিক্ষাদান প্রক্রিয়া করা হয় তবে তা একঘেয়েমি দূর করতে সক্ষম এবং শিক্ষার্থীরাও খুব সহজে তা গ্রহণ করে থাকে।
৫. শিক্ষাক্ষেত্রে প্রযুক্তিবিদ্যার অন্যতম ভূমিকা হল, শিক্ষার্থীরা খুব সহজে আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠতে পারে। সুতরাং আত্মসক্রিয়তার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের আত্মনির্ভরশীল করে তার বলিষ্ঠ জীবন আদর্শ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রযুক্তিবিদ্যার যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে।
৬. বর্তমান সমাজে সুস্থভাবে জীবনযাপন করতে গেলে প্রযুক্তি সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। এই কারণে বর্তমান যুগের শিক্ষাব্যবস্থায় প্রযুক্তিবিদ্যার একটি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। প্রযুক্তিবিদ্যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা একজন দক্ষ প্রযুক্তিবিদ-এ পরিণত হতে পারে ও সামাজিক মর্যাদা পেয়ে থাকে।
_______________________