Kd's e-pathsala Introduction to Education পরিবারের ধারণা, বৈশিষ্ট্য, কার্যাবলী এবং শিশুর শিক্ষায় পরিবারের ভূমিকা

পরিবারের ধারণা, বৈশিষ্ট্য, কার্যাবলী এবং শিশুর শিক্ষায় পরিবারের ভূমিকা



বিখ্যাত গ্রীক দার্শনিক অ্যারিস্টটল (Aristotle) বলেছেন যে, মানুষ একটি সামাজিক জীব। সে কখনো একা থাকতে পারে না। একটি সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি অকল্পনীয়। তিনি একটি গোষ্ঠী অর্থাৎ পরিবারের সদস্য হিসাবে তার দিন শুরু করেন। তাই সমস্ত মানব গোষ্ঠীর মধ্যে পরিবার হল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রাথমিক গোষ্ঠী। প্রাচীন বা আধুনিক কোনো সমাজই পরিবারতন্ত্র থেকে মুক্ত নয়। বার্গেস এবং লক (Burgess and Locke)-এর মতে, ‘সময়ের সাথে সাথে দ্রুত সামাজিক কাঠামো, প্রতিষ্ঠান এবং সম্পর্কে নানা পরিবর্তন আসার কারণে পরিবারের ধারণায় অনেক পরিবর্তন হয়েছে’।

পরিবার হল সমাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রাথমিক গোষ্ঠী (C.N.Sharkar, 1990)। প্রত্যেকেই একটি পরিবারের সদস্য এবং নিজেদেরকে দায়িত্ব ও মূল্যবোধ সম্পন্ন ব্যক্তি হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব রয়েছে তাদের উপর। এছাড়াও, সমাজের জন্য মানব সম্পদ তৈরিতে অবদান হিসাবে শিশুদের শিক্ষা দেওয়ার দায়িত্বও পরিবারের। Members of the family have the right to get the body, prevent, take care, and human rights from their parents. Members of the family need meals, clothes, home, education, health prevention, and safety. To complete these needs, the parents try to do anything to raise and complete all needs (MoEYS, 2009)। পরিবারের শিশুদের বা পরিবারের সদস্যদের আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। একটি ছোট্ট শিশুকে মানব সম্পদে পরিণত হতে পরিবার খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।

‘পরিবার’ শব্দটি এসেছে রোমান শব্দ ‘Famulus’ থেকে যার অর্থ ‘দাস’। রোমান আইনে শব্দটি প্রযোজক, ক্রীতদাস, দাস এবং সাধারণ বংশোদ্ভূত সদস্যদের গোষ্ঠীকে বোঝায়। পরিবার হল একটি ছোট দল যা বাবা, মা এবং তাদের সন্তানদের নিয়ে গঠিত যারা বিবাহ, রক্তের সম্পর্ক ​​বা দত্তক গ্রহণের ভিত্তিতে আত্মীয়তার বন্ধনের মাধ্যমে একে অপরের সাথে সম্পর্কিত। পরিবার একটি জৈবিক সংগঠন যা পিতামাতা এবং সন্তানদের নিয়ে গঠিত। কিন্তু পরিবারের অর্থ নিম্নলিখিত সংজ্ঞাগুলি থেকে আরও ভালভাবে বোঝা যায়। যেগুলি নিম্নে উল্লেখ করা হল-

According to Maclver. “Family is a group defined by a sex relationship sufficiently precise and enduring to provide for the procreation and upbringing of children.”

 

According to Burgess and Locke, “Family is a group of persons united by the ties of marriage, blood or adoption consisting of a single household interacting and inter communicating with each other in their respective social roles of husband and wife, mother and father, son and daughter, brother and sister creating a common culture.”

 

According to Kingsley Davis, “Family is a group of persons whose relations to one another are based upon consanguinity and who are, therefore, kin to another.”

 

According to Eliott and Merrill, “Family is the biological social unit composed of husband, wife and children.”

 

According to Ogburn and Nimkoff, “Family is a more or less durable association of husband and wife with or without children, or of a man or woman alone with children.”

 

According to Clare, “Family is a system of relationships existing between parents and children.”

 

 

পরিবারের বৈশিষ্ট্য
  1. পরিবার একটি সর্বজনীন গোষ্ঠী। এটি আদিম বা আধুনিক সব ধরনের সমাজেই কোনো না কোনো আকারে এর অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়।
  2. একটি পরিবারের সৃষ্টি অনেকাংশে বৈবাহিক সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে, যা বিপরীত লিঙ্গের দুই প্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে সঙ্গমে স্থাপিত হয়।
  3. প্রতিটি পরিবার প্রত্যেক সদস্যের নিজ নিজ নাম বা পরিচিতি থাকে। যেমন- দাদু-দিদা, বাবা-মা, ভাইবোন ইত্যাদি। তাই পরিবার হল এরূপ নামকরণের উৎসস্থল।
  4. পরিবার হল সেই গোষ্ঠী যার মাধ্যমে একটি বংশের পূর্ণ পরিচয় কিংবা চিত্র পাওয়া সম্ভব।
  5. প্রত্যেক ব্যক্তির জীবনে পরিবার হল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গোষ্ঠী, কেননা এরূপ গোষ্ঠীর সহায়তায় ব্যক্তি নিজেকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়।
  6. একজন ব্যক্তির সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় সহায়তাদানে পরিবার হল সবচেয়ে মৌলিক এবং গুরুত্বপূর্ণ গোষ্ঠী।
  7. একটি পরিবার সাধারণত আকারে সীমিত, এমনকি বড়, যৌথ এবং বর্ধিত হতে পারে। পরিবার সমাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গোষ্ঠী; এটি সমস্ত প্রতিষ্ঠান, সংগঠন এবং গোষ্ঠীর নিউক্লিয়াস।
  8. একটি পরিবার আবেগ এবং অনুভূতির উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। সঙ্গম, প্রজনন, মাতৃত্ব ও ভ্রাতৃত্বের ভক্তি, প্রেম এবং স্নেহ পারিবারিক বন্ধনের ভিত্তি।
  9. পরিবার মানসিক এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতার একটি ইউনিট।
  10. পরিবারের প্রতিটি সদস্য দায়িত্ব ও কর্তব্য সমানভাগে ভাগ করে নেয় এবং পরিবারের প্রত্যেক সদস্য একে অপরের প্রতি দায়িত্বশীল।
  11. প্রতিটি পরিবার স্বামী ও স্ত্রী অথবা এক বা একাধিক সন্তান নিয়ে গঠিত, উভয়ই প্রাকৃতিক  নিয়মে, দত্তক পদ্ধতিতে কিংবা বৈবাহিক সম্পর্কের ভিত্তিতে একটি পরিবারের সদস্যপদ গ্রহণ করতে পারে।
  12. পরিবারের সদস্যপদ অর্থের ভিত্তিতে ক্রয় করা যায় না।
  13. প্রত্যেক পরিবারের সকল সদস্যের নির্দিষ্ট ভূমিকা ঠিক করা থাকে, এবং সেই ভূমিকা যথাযথ পালন করা হলে পারিবারিক উন্নতি ঘটে।
 
উপরোক্ত সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে বলা যেতে পারে, পরিবার হল রক্তের সম্পর্ক, বৈবাহিক এবং দত্তকসূত্রে আবদ্ধ এমন এক স্থায়ী গোষ্ঠী যা সামাজিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্যেদিয়ে এক অভিন্ন সংস্কৃতির সৃষ্টি করে থাকে।
 


 
পরিবারের কার্যাবলী

একটি সামাজিক গোষ্ঠী এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে, পরিবার বিভিন্ন কার্য সম্পাদন করে যা নিম্নরূপ:-

  1. পরিবার হল এমন একটি সংগঠন যার মাধ্যমে বংশবৃদ্ধি ঘটে। বিবাহ হতে যৌন সম্পর্ক স্থাপিত হয়, সেখান হতে সন্তানের জন্ম হয় ফলস্বরুপ পরিবারের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে পরিবার আরও শক্তিশালী হয়।
  2. প্রজনন প্রক্রিয়া পরিবারের মাধ্যমে নির্ধারিত, নিয়ন্ত্রিত এবং সামাজিক বৈধতা পেয়ে থাকে।
  3. পরিবার একজন ব্যক্তিকে তার সামাজিক পরিচিতি প্রদান করে থাকে। পরিবারের একজন সদস্যের নাম এক প্রজন্ম হতে অন্য প্রজন্মে সঞ্চালিত হয়।
  4. পরিবার এমন একটি সংগঠন যা শিশুদের জন্ম ও তাদের লালনপালনের সাথে যুক্ত।
  5. পরিবার সামাজিকীকরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। যেকোনো ব্যক্তির প্রাথমিক সামাজিকীকরণ পরিবারের মধ্যেই ঘটে। পরিবারের নিকটবর্তী সদস্যরা একটি শিশুকে সামাজিক জীবনের সমস্ত মৌলিক নিয়ম ও নীতি শেখায়।
  6. পরিবার সাংস্কৃতির সঞ্চালনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা। সংস্কৃতি এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে পরিবারের মাধ্যমে সঞ্চারিত হয়। পারিবারিক কাঠামোর মধ্যে সংস্কৃতির সমস্ত দিক শেখানো হয়ে থাকে।
  7. পরিবার তার সদস্যদের জন্য মানসিক শক্তির সঞ্চারক হিসাবে কাজ করে। সমস্ত সদস্য সচেতন যে তারা প্রয়োজনের সময় তাদের পরিবারের উপর নির্ভর করতে পারে।
  8. পরিবারের মধ্যেও শ্রম বিভাজনের নীতি পরিলক্ষিত হয়, যেখানে সকল সদস্য একে অপরের প্রতি দায়বদ্ধ থাকে।
  9. একটি পরিবার তার সদস্যদের অর্থনৈতিক চাহিদা পূরণ করে।
  10. পরিবার ঐতিহ্যগতভাবে শিশুদের শিক্ষার জন্য দায়ী।
  11. পরিবারের একটি বিনোদনমূলক দিক রয়েছে। অতীতে বেশিরভাগ বিনোদনের কেন্দ্র ছিল পরিবার। উৎসব, অনুষ্ঠান, পারিবারিক পুনর্মিলন, বিবাহের সময় পারিবারিক জমায়েত সমগ্র পরিবারকে একত্রিত করে অনুষ্ঠিত হয়। এখনকার দিনে, পরিবারের সদস্যদের ছুটির দিনে বা সিনেমা, নাটক, ডিনার বা পার্টি ইত্যাদির জন্য বাইরে নিয়ে যাওয়া এই বিনোদনমূলক দিকটিকে চিহ্নিত করে।

 

 
পরিবারের শ্রেণীবিভাগ
পরিবারের শ্রেণীবিভাগ নিম্নে একটি চিত্রের মাধ্যমে দেখানো হল-
Fig: Types of Family

 

পরিবারের শিক্ষামূলক ভূমিকা 

পরিবার বলতে স্থায়ীভাবে বসবাসকারী জনসমষ্টি কে বোঝায়। পরিবারের প্রত্যেক সদস্যদের মধ্যে আবেগ ও অনুভূতির ভিত্তিতে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পরিবার একজন শিশুর বিভিন্ন দিকের বিকাশে কার্যকারী ভূমিকা পালন করে থাকে। এর মধ্যে শিক্ষাগত দিকটি হল অন্যতম। পরিবারের শিক্ষামূলক ভূমিকা নিম্নে আলোচনা করা হল-

 

  1. ভাষার বিকাশ : ভাষা হল মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যম। একজন শিশুর ভাষাজ্ঞান, শব্দভাণ্ডার ইত্যাদি যা একজন শিশুর শিক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে তার বিকাশ বিশেষত পরিবারের মধ্যেই হয়ে থাকে। শিশু যে পরিবারে জন্মগ্রহণ করে সেই পরিবারের সদস্যদের সংস্পর্শে এসে শিশুর ভাষার বিকাশ ঘটে। 
  2. নৈতিক মূল্যবোধ গঠন : ভাল-মন্দ, উচিত-অনুচিতের মধ্যে পার্থক্য একজন শিশু পরিবারের মধ্যে থেকে শেখে। প্রত্যেকটি পরিবারের একটি নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে, একজন শিশু সেই বৈশিষ্ট্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে। 
  3. ব্যক্তিত্বের বিকাশ একজন শিশুর ব্যক্তিসত্ত্বার বিকাশে পরিবার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। একটি ছোট্ট শিশুর স্বভাব হল বাড়ির অন্যান্য সদস্যদের অনুকরণ করা। সেহেতু বাড়ির অন্যান্য সদস্যদের যথার্থ অনুকরণের মাধ্যমে পারিবারিক ঐতিয্যকে বজায় রাখে। এমনকি পোশাক, খাদ্যের ধরণ, শখ, ভঙ্গী ইত্যাদিও অনুকরণ করে থাকে, এগুলি তার ব্যক্তিত্বের বিকাশ সাধনে সহায়তা করে।
  4. বৃত্তি নির্বাচনে সহায়তা : বৃত্তি নির্বাচনের ক্ষেত্রে পরিবার প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করতে না পারলেও, পরোক্ষ ভূমিকা পালন করে থাকে। প্রাচীনকালে বৃত্তিশিক্ষার সম্পূর্ণ দায়িত্ব পরিবারের হাতেই ন্যস্ত ছিল। কিন্তু বর্তমানে এই ধারণার পরিবর্তন ঘটেছে, বর্তমানে পরিবার প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করে না ঠিকই, কিন্তু বৃত্তি নির্বাচনের জন্য প্রাথমিক তথ্য ও মানসিক প্রস্তুতি আনতে সহায়তা করে থাকে।
  5. মানসিক বিকাশ : পরিবারিক আবহাওয়া, স্নেহ, প্রীতি একজন শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যের বিকাশের জন্য অনুকূল পরিবেশ রচনা করে। যার ফলে দৈহিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটে এবং শিশুকে শিক্ষার জন্য উপযুক্ত করে গড়ে তোলে।
 
পরিবার হল সমাজের সবথেকে প্রাচীনতম প্রতিষ্ঠান। সেই প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে বর্তমানেও একজন শিশুর শিক্ষায় পরিবার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। একজন শিশু তার জন্মের পর বেশ কিছুটা সময় শুধুমাত্র পরিবারের মধ্যে কাটায়, এখান হতেই তার নানান দিকের বিকাশের সূত্রপাত ঘটে। শিশুর শিক্ষায় বিদ্যালয় প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করে ঠিকই, কিন্তু পরিবারের সাহায্য ব্যতীত বিদ্যালয়ও শিশুর সর্বাঙ্গিন বিকাশে সক্রিয় ভূমিকা পালনে সক্ষম হয় না। সেহেতু একজন শিশুর শিক্ষায় পরিবারের ভূমিকা খুবই গুরত্বপূর্ণ।  
 

 

  
 
সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি
  • ইসলাম, নূরুল। শিক্ষাতত্ত্বের রুপরেখা। শ্রীধর প্রকাশনী, পৃষ্ঠা : ৫৯-৬৫
 
  
______________________________________

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *